আইসিবি’র অনিয়ম ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি

ছবি: সংগৃহিত

পুঁজিবাজারে সরকারি একমাত্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি), নানা অনিয়মে জর্জরিত এই প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরই অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ঠিক করার জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, পুঁজিবাজারের খারাপ অবস্থায় সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গঠন করা হয় আইসিবি। এখন উল্টো আইসিবিকেই প্রতিনিয়ত সাপোর্ট দিতে হচ্ছে। সম্প্রতি বিএসইসির পক্ষ থেকে আইসিবিকে পুনর্গঠনে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞতিতে পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশের পুঁজিবাজারকে সহায়তা করাই ছিল আইসিবি গঠনের উদ্দেশ্য। কিন্তু কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ হিসাব বছরে প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিক লোকসান দিয়েছে এবং মূলধন হারিয়েছে। উৎপাদন খাত ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায় করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়েছে। যদিও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়াটা কোনোভাবেই পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই আইসিবি যেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছে সেগুলোর পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রয়েছে এবং লক-ইন থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানটি সেসব কোম্পানির শেয়ারও বিক্রি করতে পারছে না। এতে আইসিবির পোর্টফোলিওর মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। আইসিবিকে মূলধন সহায়তা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার ভর্তুকি দেয়া হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

এতে আরো বলা হয়েছে, আইসিবিকে ভর্তুকি দেয়া সঠিক হবে কিনা, এ মুহূর্তে সরকারকে এটি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আর আইসিবির সার্বিক কার্যক্রম বিশ্লেষণ, এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ম্যান্ডেট অনুসারে যেসব কাজ করেছে সেগুলোর তালিকা তৈরি, বর্তমানে পুঁজিবাজারে আইসিবির ভূমিকা, প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ও অ-আর্থিক সম্পদের অবস্থা, এর সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামো, জনবল সক্ষমতার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায়োগিকতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরকারের পক্ষে আইসিবিকে মূল্যায়ন করা সম্ভব বলে মনে করছে বিএসইসি।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে আইসিবির বর্তমান ও ঐতিহাসিক আর্থিক এবং অ-আর্থিক পারফরম্যান্স, সার্বিক কার্যক্রম, পুঁজিবাজার উন্নয়নে আইসিবির ভূমিকার পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিবি যথাযথভাবে তার দায়দায়িত্ব পালন করছে কিনা সেটি পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। আইসিবির প্রকৃত ব্যবসায়িক সুযোগ খুঁজে বের করা, বিনিয়োগ কৌশল, পোর্টফোলিওর ঝুঁকি বিশ্লেষণ, পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যকরণ, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া, তহবিলের উৎস ও ব্যবহার এবং আইসিবি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পর্যালোচনা করবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া ঋণ নীতিমালা ও প্রক্রিয়া এবং ঋণ আদায় কার্যক্রমও পর্যালোচনা করবে তারা। সিকিউরিটিজ এবং অন্যান্য আইন ও বিধিবিধান পরিপালন করছে কিনা এবং এক্ষেত্রে কোনো ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে কিনা সেটিও পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।

আইসিবি সম্পর্কে পুঁজিবাজারের স্টেকহোল্ডারদের আবেগ ও প্রত্যাশা এবং প্রতিষ্ঠানটি তা পূরণ করতে পারছে কিনা, সেটি মূল্যায়ন করতে হবে। আইসিবির আর্থিক ও অ-আর্থিক সম্পদ পর্যালোচনা করা এবং এসব সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার হয়েছে কিনা, সেটি পরীক্ষা করে দেখার পাশাপাশি এর যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ করতে হবে।

প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি কাঠামো, জনবল এবং আইসিবি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতার বিষয়টি পর্যালোচনার পাশাপাশি এসব বিষয়ে কীভাবে উন্নতি করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শককে সুপারিশ করতে হবে। আইসিবিকে তদারকির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির ভূমিকা পর্যালোচনার পাশাপাশি বিদ্যমান অচলাবস্থা থেকে আইসিবিকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কীভাবে সহায়তা করতে পারে, সেটি খুঁজে দেখবে পরামর্শক। আইসিবি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক দুরবস্থার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি উত্তরণের উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দেবে। আইসিবির পারফরম্যান্স উন্নতির জন্য করণীয় এবং দীর্ঘমেয়াদে পুঁজিবাজারকে সহায়তাসহ মার্কেট মেকার হিসেবে এর ভূমিকার বিষয়ে সুপারিশ করবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সর্বোপরি আইসিবিকে পুনর্গঠনের বিষয়ে সুপারিশের পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত বিএসইসির কমিটির নির্দেশনা অনুসারে অন্য যেকোনো ইস্যুতে কাজ করবে পরামর্শক কমিটি।

পুঁজিবাজারে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসির মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সেখানে আইসিবিকে পুনর্গঠনে পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সরকারের নির্দেশে বিএসইসিকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তাদের সুপারিশ চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করবে অর্থ মন্ত্রণালয়।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনার পাশাপাশি প্রধান স্টেকহোল্ডারদের সাক্ষাত্কার নেবে। আইসিবি পুনর্গঠনসংক্রান্ত বিএসইসির কমিটির কাছে পরামর্শককে প্রেজেন্টেশনসহ দুটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। কমিটির মতামত আমলে নেয়াসহ কার্য অনুসন্ধান করে চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে পরামর্শককে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিএসইসির কাছে পরামর্শক হিসেবে আবেদন করতে হবে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, ব্যবসায়িক ও আর্থিক বিষয়ে কনসালটেন্সির ক্ষেত্রে তাদের ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটি নিজের কিংবা তাদের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন থাকা প্রতিষ্ঠানের এমএসসিআই ডেভেলপড মার্কেট ইনডেক্স, এসঅ্যান্ডপি ইনডেক্স, ডাওজোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ কিংবা এফটিএসই ইনডেক্সে থাকা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

২০১৮-১৯ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, আলোচ্য হিসাব বছরে আইসিবির পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা, যা এর আগের ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ছিল ৬৬৭ কোটি টাকা। আর ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে প্রতিষ্ঠানটির কর পরর্বতী নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র ৬০ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে তা ছিল ৪১৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০১৯-২০ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) আইসিবির ৪৮ কোটি টাকা কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছে, যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা হয়েছিল ৬৯ কোটি টাকা।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *