ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফানের’ আঘাতে বিপর্যয়ের কবলে দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা। প্রায় সোয়া দুই কোটি গ্রাহক দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছন্ন ছিল। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের অন্য এলাকতেও ঝড়ের প্রভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও উপকূলীয় এবং উত্তরের অনেক জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রায় এক কোটি গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎহীন।
বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত লাইন মেরামতের কাজ চলবে। তারপরও ৬০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গ্রিড সাব স্টেশনে আগুন লাগায় কুষ্টিয়া জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট দীর্ঘ হতে পারে। এছাড়া রংপুর বিভাগের কিছু এলাকায় খারাপ আবহাওয়া ও সঞ্চালন লাইনের উচ্চ ভোল্টেজের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। বিতরণ সংস্থাগুলো জানিয়েছে চাহিদা কম থাকায় সচল এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ বেড়ে যায়। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে অনেক এলাকায় সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। দুর্ঘটনা এড়াতেও কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল।
প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ঝড়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। আম্ফানে সারা দেশে প্রায় আড়াই হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাড়ে ৫ হাজার পোল হেলে পড়েছে। গাছ ভেঙে পড়ে সাত থেকে আট হাজার কিমি লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রায় ৯শ ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে। মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ঝড়ের কারণে ভোলা, বরগুনা, বরিশাল, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকায় গাছ পড়ে বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পোল ভেঙে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ এলাকা রাতের মধ্যে বিদ্যুৎ সরকরাহ স্বাভাবিক হবে। কিছু এলাকায় বিতরণ লাইনে বেশি ক্ষতি হওয়া মেরামতে সময় লাগবে। তবে আশা করা যায় শুক্রবারের মধ্যে প্রায় সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।
স্বাভাবিক সময়ে এই মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট হলেও আম্ফানের কারণে বুধবার রাতে তা আড়াই হাজার মেগাওয়াটে নেমে যায়। বিতরণ ব্যবস্থার মেরামতের পরও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চাহিদা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট পেরোয়নি।
আম্ফানে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সারা দেশে গ্রাহক দুই কোটি ৮৫ লাখ। তার মধ্যে প্রায় দুই কোটি গ্রাহক ঝড়ের কারণে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল জানান আরইবির সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অঞ্জন কান্তি দাশ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত ৮৫ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে রয়েছে। তারা রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করবেন। এরপর ৩০ লাখ থেকে ৩৫ লাখ গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি জানান, প্রায়, ২৬ হাজার স্পটে তার ছিঁড়ে গেছে। ১৭শ খুঁটি ভেঙে গেছে, তিন হাজার ৭০০ পোল হেলে গেছে। ২০ হাজার গ্রাহকের মিটার ভেঙে গেছে। ৭২৬টি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে। টাকার অঙ্গে ক্ষতির পরিমাণ আপতত ২০ কোটি টাকা। এটা আরও বাড়তে পরে।
আরইবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, যশোর ও পটুয়াখালী জেলার বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া জানান, কুষ্টিয়া ১৩২/৩৩ কেভি গ্রিড সাব স্টেশনে দুটি ট্রান্সফরমার জ্বলে গেছে। ফলে কুষ্টিয়াসহ পাশের কয়েকটি জেলায় বিদ্যুৎ সরবারহ বন্ধ রয়েছে।
কিবরিয়া জানান, ট্রান্সফরমার মেরামতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। ভেড়ামারা থেকে বিদ্যুৎ এনে বিকল্প উপায়ে জরুরী স্থাপনায় সরবরাহের চেষ্টা করছে আরইবি। দেশের অন্য স্থানে সঞ্চালন লাইনে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। সেখানে বিতরণ সংস্থাগুলো লোড কমিয়ে দেওয়ার কারণে হয়েছে। চাহিদা অনুসারে সরবরাহ করা হচ্ছে।
রাজশাহীর আট জেলার বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকিউল ইসলাম বলেন, তারা অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করতে পেরেছেন। তবে ঝড় থাকায় লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, পাটগ্রাম কালিগঞ্জ উপজেলায় সরবরাহ স্বাভাবিক করা যায়নি। এছাড়া দুর্ঘটনা এড়াতে বৃষ্টি হচ্ছে এমন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় বিদ্যুৎ সরবারহের দায়িত্বে থাকা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ওজোপাডিকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন জানান তাদের, মোট ১২ লাখ গ্রাহকের মধ্যে সাত লাখ গ্রাহকের সংযোগ চালু হয়েছে। ১৯ জেলায় আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। পাাঁচ লাখ গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎহীন রয়েছে।