একজন সম্রাট

কিংবদন্তি এন্ড্রু কিশোর

এই জগত সব সময়ই কিছু ক্ষণজন্মার পরশে সবুজ থেকে আরো জীবন্ত সবুজে রূপ লাভ করে। এই মানুষ গুলো নিজের কর্মক্ষেত্রে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে তাদের লিজেন্ড বলাও যায় না, তার থেকে আরও বড় কিছু এদের নামের সামনে যুক্ত না করলে তা মানায় না। এন্ড্রু কিশোর,  হ্যা এই মানুষটি তাদের মধ্যেই একজন। যার নামের প্রথমে সম্রাট অথবা দ্যা কিং উপমা’ই শোভনীয়।

আমাদের গানের সম্রাট এন্ড্রু কিশোর। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আসলেই কি চলে যাওয়া যায়! এইভাবে?  এই যাওয়াটা কি এতই সহজ তার কোটি ভক্তের মগজ থেকে?

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর। মা মিনু ও বাবা বাড়ৈয়ের কোল আলোকিত করে জন্ম নিল এক ফুটফুটে শিশু। মা তাঁর প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের নামে সদ্যোজাত সন্তানের নাম রাখলেন ‘কিশোর’। ধীরে ধীরে ছেলেটি বড় হয়ে সংগীতাঙ্গনে পা রাখল। তারপর কোনো একদিন স্বমহিমায় সেই ছেলে কিশোর কুমারের গানে ভাগ বসালো। তিনি আর কেউ নন! আমাদের বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর।

মা রাজশাহীর বুলনপুর মিশন গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা থাকায় সেখানেই পড়াশোনায় হাতেখড়ি। সংগীত পাঠ শুরু রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। আশির দশকে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখার পর থেকে বাংলা, হিন্দিসহ কমপক্ষে ১৫ হাজার গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন।

তিনি রাজশাহী বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। প্রথম প্লেব্যাক করেন আলম খানের সুরে ‘তুফান মেইল’ চলচ্চিত্রে। প্রতীক্ষা ও এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর পর নিজের ক্যারিয়ারের শুভ সূচনা হয়। আশির দশকের প্রথম দিকে সব্যসাচী লেখক; সৈয়দ শামসুল হকের কথা ও আলম খানের সুরে  ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার…
“হায়রে মানুষ, রঙ্গীন ফানুস
দম ফুরাইলেই ঠুস
তবুতো ভাই কারোরই নাই একটুখানি হুশ”

‘হায়রে মানুষ’ এ গানের মধ্যে দিয়েই নবীন গায়কের কন্ঠে মুগ্ধ শ্রোতামহল। জুরি বোর্ডের রায়ে সেই নবীন গায়ক মহারথীদের হারিয়ে অর্জন করে নিয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারে কিংবদন্তী সুরকার আলম খান বেশ গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব, উনিও এই সিনেমা দিয়ে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। পাশ্চাত্যর ধারা মিশিয়ে এই জুটির আরেক সাড়া জাগানো গান ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’। এছাড়া, জাফর ইকবালের ‘নয়নের আলো’ যুগান্তকারী সিনেমায়।

এছাড়া জাফর ইকবালের যগান্তকারী সিনেমা নয়নের আলো’তে প্রয়াত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা ও সুরে ‘আমার সারা দেহ খেয়ে গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, গানগুলো বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয়। সবগুলো গানের গায়ক ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার গানের মাধ্যমে যে শুভসূচনা হয়েছিল সেটার পরিপূর্ণ যাত্রা শুরু হয় ‘নয়নের আলো’ সিনেমা দিয়ে।

সেই থেকে শুরু, আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলা চলচ্চিত্রের গানে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করলেন, একের পর এক বাংলা জনপ্রিয় গান নিজের কন্ঠে উপহার দিলেন। মুগ্ধ করলেন শ্রোতাদের।

আশির দশকে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গেও তার দারুণ মিলে যেতো। এই জুটি অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। সহযাত্রী সিনেমার বিখ্যাত গান ‘পৃথিবীর যত সুখ’ এবং এক সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে ব্যবসা করা সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’র সাড়া জাগানো টাইটেল গানটিও গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এছাড়া ‘ভাই বন্ধু’ সিনেমার ‘ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, এবং আঁখি মিলন সিনেমার ‘আমার গরুর গাড়িতে” সহ
বিশেষ ভাবে বলতে হয় বিখ্যাত  “ভেজা চোখ” সিনেমার ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ এই গানটি সারাবাংলার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

বাংলা চলচ্চিত্রে গানের দিক দিয়ে আরেক যুগান্তকারী সিনেমা ‘দুই জীবন’। জাতীয় পুরস্কার জয়ী এই সিনেমার জনপ্রিয় গান আমি “একদিন তোমাকে না দেখলে” এবং শ্রুতিমধুর গান “তুমি আজ কথা দিয়েছো”র কালজয়ী গানও তিনি গেয়েছিলেন।

স্যারেন্ডার সিনেমার ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’ গানের জন্য এবং ক্ষতিপূরণ সিনেমা ‘এই দুটি ছোট্ট হাতে’র জন্য অর্জন করেন তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

তুমি আমার কত চেনা’
তুমি আরো কাছে আসিয়া”
‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না, নায়ক আলমগীর অভিনীত অন্যতম সেরা গান গুলোও গেয়েছেন এই কিংবদন্তি.. আশির দশকের সফলতার রেশে নব্বই দশকেও তিনি সমান তালে সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়কের আসনে থাকেন। বিয়ের ফুল সিনেমার ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’ এবং অনুতপ্ত সিনেমার ‘তুমি এসেছিলে পরশু’  জনপ্রিয় এই গান গুলোও তিনি কন্ঠে ধারন করেছেন।

নায়ক সালমান শাহ অভিনীত অন্তরে অন্তরে সিনেমার ‘এইখানে দুইজনে নির্জনে’ ও আনন্দ অশ্রুর ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ এবং ‘স্বপ্নের ঠিকানা’র গানগুলোও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। এছাড়া বিশেষ ভাবে বলতে হয়-
‘তোমাকে চাই’ সিনেমার কালজয়ী গান ‘ভালো আছি ভালো থেকো। এ গান গুলো আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে.. তাছাড়া কুলি সিনেমার ‘আকাশেতে লক্ষতারা চাঁদ কিন্তু একটাই’ তো উনার ক্যারিয়ারে আরেক হিট গান।

চিত্রনায়ক রিয়াজ অভিনীত সিনেমায়ও তিনি প্লেব্যাক করেছেন। ‘প্রানের চেয়ে প্রিয়’ সিনেমার ‘পড়েনা চোখের পলক’
এছাড়া তুমি হাজার ফুলের মাঝে | তুমি চাঁদের জোছনা নও| ঘুমিয়ে থাকো গো স্বজনী | এসব গানেও তিনি শ্রোতাদের মন জয় করেছেন।

সর্বশেষ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন কি যাদু করিলা সিনেমার ‘চক্ষু দুইটা কাজল কালো’ গানের জন্য।
শাকিব খান অভিনীত সিনেমায়- ‘আমার হৃদয় একটা আয়না’ এছাড়া ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে’, এক বিন্দু ভালোবাসা দেও এসব জনপ্রিয় গানও তিনি গেয়েছেন।

প্লেব্যাকে তিনি রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন ও কনকচাঁপার সঙ্গে জুটি বেঁধে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন।
সুরকার হিসেবে কাছে পেয়েছেন আলম খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলী, শেখ সাদী খান, ইমন সাহা এবং গীতিকার হিসেবে গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মনিরুজ্জামান মনির, মো: রফিকুজ্জামান, কবির বকুল সহ আরো অনেকের গানে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন। কলকাতাতেও প্লেব্যাক করেছেন বেশ কয়েকটি। বেশ লম্বা সময় এন্ড্রু কিশোর প্লেব্যাকে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, অন্য কোথাও সময় দিতে পারতেন না। প্লেব্যাকের বাইরে এসে তিনি ইত্যাদিতে প্রথম গান করেন ‘পদ্ম পাতার পানি নয়'” যা বেশ দর্শক জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে আরো বেশ কয়েকবার তাকে ইত্যাদিতে এবং টিভি অনুষ্ঠানের বিচারকের আসনে দেখা গেলেও প্লেব্যাকে অনিয়মিত হয়ে যান। বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি সেরা গায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।

যার জীবন তার সৃষ্টি দিয়ে এত আলোকিত করেছে বাঙালির গানের প্রেমকে, তাকে সত্যি সম্রাট ছাড়া কিছুই বলা ঠিক মানায় না।

এন্ড্রু কিশোর, আপনার গানের মত করেই বলছি – হয়ত আপনার দেহ মাটি খেয়ে ফেলবে, চক্ষু দুটাও খেয়ে ফেলবে এই মাটি। কিন্তু এই বাংলার বাঙালির মগজে আর অন্তের আপনার যে স্থায়ী বসঘর, তা নুন্যতম মলিন করার সাধ্য কারো নেই।

সম্রাট তুমি চলে যাও যেখানে খুশি, আমার তোমার সৃষ্টিকে বুকেই রেখে দিলাম।

লেখক: রাশেদ আলম, সমাজকর্মী ও কথাসাহিত্যিক 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *