শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড খুনের ঘটনায় বিক্ষোভের আঁচ এ বার এসে পড়ল গির্জাতেও। ভাঙচুর, লুটপাট, মারামারি চলছিলই। রবিবার রাতে বিক্ষুব্ধ জনতার একাংশ তাণ্ডব চালায় হোয়াইট হাউস লাগোয়া সেন্ট জন্স গির্জায়। পুড়ল গির্জার বেসমেন্ট এবং নার্সারির একাংশ। সোমবার সেই পোড়া গির্জার সামনেই বাইবেল হাতে ‘পোজ়’ দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউস থেকে খানিক আগেই বিক্ষোভ দমনে সেনা নামানোর হুমকি দিয়ে আসা প্রেসিডেন্ট এখানেও বললেন, ‘‘প্রতিবাদের নামে এই ধ্বংসলীলা চলতে পারে না। এই মহান দেশকে দুষ্কৃতীকারীদের হাত থেকে রক্ষা করবই।’’
বিক্ষোভ দমনে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কাল বললেন, ‘‘স্থানীয় প্রশাসন না-পারলে এ বার আমিই ব্যবস্থা নেব। হাজার হাজার সশস্ত্র সেনা পাঠাচ্ছি। দাঙ্গা, লুটপাট, হামলা ওরাই সামলাবে।’’ সূত্রের খবর, বাইরে বিক্ষোভের জেরে শুক্রবার রাতে হোয়াইট হাউস অন্ধকার করে বেসমেন্ট-বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। কাল অবশ্য দু’পাশে সিক্রেট সার্ভিস আর পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তা নিয়েই হাঁটাপথে গির্জা পরিদর্শনে গেলেন ট্রাম্প। গত কয়েক দিনে বিক্ষোভের ‘হটস্পট’ হয়ে ওঠা হোয়াইট হাউস লাগোয়া পার্ক আগেই ‘ঠান্ডা’ করে এসেছিল পুলিশ। শুধু মোছা যায়নি গির্জার দেওয়ালে স্প্রে-পেন্টিং করে লেখা— ‘‘শয়তানটা এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়!’’ ট্রাম্প পার্কের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন, সেই ভিডিও রিটুইট করে প্রেসিডেন্ট পুত্র জুনিয়র ট্রাম্প লিখলেন, ‘‘এই সেই ব্যক্তি, যিনি বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে গলা চড়াচ্ছিল মিডিয়া আর বামেরা।’’
বিক্ষোভকারীদের এই বেপরোয়া মনোভাবটাই ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে। বলা হচ্ছে, ১৯৬৮-তে মার্টিন লুথার কিংয়ের হত্যা-পরবর্তী অশান্তির পরে এমন বিক্ষোভ আর দেখেনি আমেরিকা। কিন্তু কেন? বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, বর্ণবিদ্বেষের আগুনটা জ্বলছিলই, করোনায় বঞ্চনার ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভাইরাস-যুদ্ধেও যে কৃষ্ণাঙ্গরা বঞ্চনার শিকার, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন সম্প্রতি। তাই রাগ ছড়াচ্ছে ভাইরাসের চেয়েও দ্রুত। করোনার জেরে বেকারত্বের জ্বালা বাড়তি ঘি ঢেলেছে আগুনে, বলছেন বিশেষজ্ঞরাই। এ দিকে সোমবার হাতে পাওয়া বেসরকারি ও সরকারি জোড়া অটোপসি রিপোর্টের উল্লেখ করে জর্জের পারিবারিক আইনজীবি জানিয়েছেন, পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিনের হাঁটুর চাপে শ্বাসরুদ্ধ হয়েই মৃত্যু হয় জর্জের। এই রিপোর্টেও পারদ চড়েছে মিনিয়াপোলিস থেকে শুরু করে সর্বত্র।
পরিস্থিতির সামাল দিতে ছয়টি প্রদেশ এবং অন্তত ১৩টি প্রধান শহরে জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। রাজধানীসহ নৈশ-কারফিউ চলছে দেশের প্রায় ১৫০ শহরে। ৬৭ হাজার ন্যাশনাল গার্ড টহল দিচ্ছে দেশ জুড়ে। একাধিক সংবাদ সংস্থা বলছে, এই বহর ইতিহাসে প্রথম! ইতিমধ্যেই গ্রেফতার প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিবাদী।
বিক্ষোভ তবু চলছেই। একাধিক স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, দিনে তবু কিছুটা শান্তিপূর্ণ থাকলেও, সূর্য ডুবলেই শুরু হচ্ছে তাণ্ডব। লিঙ্কন স্মৃতিসৌধের পাশাপাশি বিক্ষোভের আঁচ গিয়ে পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিসৌধেও। লকডাউনের জেরে এমনিতে এখন সুনসান আমেরিকার বেশির ভাগ শহরের রাস্তাঘাট। আর সেই সুযোগেই বন্ধ শপিং মল, দোকানের শাটার ভেঙে চলছে লুটপাট। প্রশাসন সূত্রের খবর, গুলির লড়াইয়ে অন্তত ৫ পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন।
নিউ ইয়র্কে রাত ১১টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কারফিউ ছিলই। মিডটাউন, দক্ষিণ ম্যানহাটন, ম্যাডিসন ভিউ-সহ একাধিক এলাকা থেকে দোকান লুটপাটের ফুটেজ সামনে আসার পরেই কারফিউ জারি হচ্ছে রাত ৮টা থেকে। সেই ঘোষণা করতে গিয়েই নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো বললেন, ‘‘রাতের অন্ধকারে কিছু মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে নয়, শুধুই লুটপাট আর বাকিদের ক্ষতি করতে বেরোচ্ছে। এই অরাজকতা থামাতেই হবে আমাদের।’’ রাত ১১টার পরে অবশ্য ব্রুকলিনে দেখা গিয়েছে, শান্তিপূর্ণ ভাবেই এক দল প্রতীকী প্রতিবাদ জানাচ্ছেন হাঁটু মুড়ে। কারফিউ চলছে, তবু পুলিশ শুধু দূর থেকে নীরবে দেখে গিয়েছে তাঁদের।
জনতার এই প্রতিবাদ ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ বলে মানতে রাজি নয় সরকার। একাধিক প্রাদেশিক প্রশাসনের দাবি, বহিরাগতেরাই তাণ্ডব চালাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিশানা করছেন, ‘নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী দাঙ্গাবাজ চরম বামপন্থীদের’। ‘মার্কিন জনগণের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনা নামানোর’ হুমকির পাল্টা আবার তাঁকেই বিধেছেন আগামী ভোটে ট্রাম্পের সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন। তাঁর কথায়, ‘‘নিজে গির্জায় গিয়ে ছবি তোলাবেন বলে তাঁর পুলিশ গিয়ে রাবার বুলেট, লঙ্কাগুঁড়ো ছড়িয়ে পার্ক পরিষ্কার করে দিল। এই লোকটাকে হারাতেই হবে। দেশের স্বার্থরক্ষার্থেই হারাতে হবে।’’