চিতলমারীতে তিন টাকা টমেটোর কেজি! হতাশা আর হাহাকার কৃষকের!

বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় টমেটোর বাম্পার ফলন হলেও ন্যায্য দাম পাচ্ছেনা  টমেটো চাষী। একপ্রকার মধ্যসত্বভোগী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে থাকা টমেটো বাজারের দাম ইচ্ছে-খুশিমতো ওঠানামা করছে। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন হাজার হাজার টমেটো চাষী।  কৃষি বিপনণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের বাজার মনিটরিং শক্তিশালী করা হলে এবং সরকারীভাবে টমেটো সহ সকল কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে তা প্রত্যেক বাজার ও আড়তে দৃশ্যমানের ব্যবস্থা করা হলে কৃষক ন্যায্য দাম পাবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু সরকারী কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে চিতলমারীর টমেটো চাষীর জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। বাম্পার ফলন ফলিয়েও তারা তাদের আসল দাম ঘরে তুলতে পারছেন না বলে জানান। শ্যামপাড়া গ্রামের চাষী প্রকাশ মজুমদার, দুর্গাপুর গ্রামের লিটন সোমসহ অনেকে জানান, তাদের টমেটো চাষে যে টাকা খরচ গেছে, হঠাৎ করে বাজারের দরপতন হওয়ায় আসল টাকাই উঠবে না। এখন দিশেহারা অবস্থা। দেনাগ্রস্থ হয়ে এই টমেটো চাষ করেও এখন দেনার ভার আরো বেড়ে গেছে।

বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় উৎপাদিত টমেটো ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে প্রায় পাঁচ-ছয় গুন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ ন্যায্যদাম হতে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকেরা। প্রতিদিন চিতলমারী হতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গড়ে প্রায় দুই কোটি টাকার টমেটো যায়। প্রতিকেজি টমেটো কৃষকের কাছ হতে দুই  থেকে তিন টাকা দরে কিনে তা শহরাঞ্চলে ২৫ থেকে ৩০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা যায়। এদিকে গ্রামে প্রতিদিন কমছে টমেটোর দাম। চিতলমারীতে শত শত হেক্টর ক্ষেতের টেমেটো পেঁকে পেঁকে বিনষ্ট হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে টমেটো উৎপাদনকারী প্রায় ১৯ হাজার চাষী ও তাদের পরিবার হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। টমেটো সংরক্ষণ বা বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় স্থানীয় পাইকারী ক্রেতাদের প্রতিমুহুুর্তে পরিবর্তিত মৌখিক বাজারদরেই চাষীরা টমেটো বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অপরদিকে স্থানীয় পাইকারীরা জানান, ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা দাম না বাড়ালে তাদের কিছুই করার থাকেনা। এমন ঘুর্নাবর্তে চিতলমারীর টমেটো চাষীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। এই অবস্থায় কৃষকের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি বিপনণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা। শুক্রবার  (৩১ জানুয়ারী, ২০২৫) চিতলমারীর বিভিন্ন মাঠ ও বাজার সরেজমিনে গিয়ে টমেটো চাষী, স্থানীয় ব্যবসায়ী সহ নানা পর্যায়ে আলাপকালে জানা যায়, সরকারী কোন মূল্য তালিকা এলাকার টমেটো ব্যবসায়ীদের দোকান কিংবা আড়তে দৃশ্যমান নেই। যা ভোক্তা অধিকার আইনকে লঙ্ঘিত করে। এছাড়া, সরকারের ‘জাতীয় কৃষি বিপনণ নীতি ২০২৩’এর ৪.১৯ ধারায় ‘কৃষিপণ্যের সর্বনিন্ম ও সর্বোচ্চ যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ এবং বাস্তবায়ন’র কথা লিখিতভাবে থাকলেও তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। এই মূল্য তালিকা দৃশ্যমান থাকলে এবং সরকারী মনিটরিং থাকলে হাজার হাজার টমেটো চাষী তাদের ন্যায্যতা পেতেন। তাই এই বিষয়ে দ্রুত জরুরীভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকরী পদক্ষেপ প্রার্থনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।

অপরদিকে, ঢাকার খিলগাঁও মেরাদিয়া বাজার হতে প্রতিকেজি টমেটো ৩০ টাকা দরে কিনেছেন বলে জানান জান্নাতী আক্তার। এছাড়া গাজীপুর ও ঢাকার অন্যান্য এলাকায় বসবাসকারী চিতলমারী সন্তান বাবলু মন্ডল, আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ অনেকে মোবাইলে জানান, প্রতিকেজি গোলাকার টমেটো ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে কিনেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা জানান, চিতলমারী হতে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র তিন/চার ঘন্টা। এই সময়ের ব্যবধানে মধ্যস্বত্ত্বভোগী সিন্ডিকেট লাভবান হচ্ছেন। আর কৃষকেরা দেনাগ্রস্থ হয়ে চলেছেন। কৃষকের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে স্থানীয় কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের কোন ভূমিকা মাঠ পর্যায়ে দৃশ্যমান নয় কেন? অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাম্পার ফলন ফলিয়ে কৃষকের “লাভের গুড় খায় পিঁপড়ায়!’’ অচিরেই কৃষকের পাশে সরকারের দাড়ানো উচিৎ!

চিতলমারীর খড়মখালী গ্রামের বাসিন্দা টমেটো আড়তদার মো. আশরাফ আলী শেখসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টমেটো ক্রেতারা জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর সহ শহরাঞ্চলের বড় আড়তদার ব্যবসায়ীদের কাছে তারা ধরা। কারণ, বড় ব্যবসায়ীদের চাহিদার উপর টমেটোর বাজারদর ওঠানামা করে। কোল্ডস্টোর নির্মাণ কিংবা টমেটোর সোয়াচ তৈরীকারক কোম্পানীকে চিতলমারীর টমেটো ন্যায্যদামের কেনার ব্যাপারে কৌশলী পদক্ষেপ নিতে সরকারী উদ্যোগ নিলেও কৃষক উপকৃত হবে। চিতলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপস পাল জানান, টমেটো উৎপাদনকারী কৃষক যাতে ন্যায্যমূল্য পায় সেই বিষয়ে যথাযথ দপ্তর ও কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে অচিরেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মূল্যতালিকা আগে থেকেই দৃশ্যমান থাকা উচিৎ। কোন কেউ কৃষকদের ঠকিয়ে টমেটো বাজারের ফায়দা নিচ্ছে কি-না তাও দেখা দরকার।

কৃষি পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকির দায়িত্বে থাকা বাগেরহাট জেলা কৃষি বিপনণ কর্মকর্তা সুমন হুসাইন জানান, টমেটোর চাহিদা যদি না থাকে তাহলে বাজারদর তো কমেই যাবে। এক্ষেত্রে কী-ই বা করার আছে! ‘জাতীয় কৃষি বিপণন নীতি ২০২৩’ অনুযায়ী চিতলমারীতে উৎপাদিত এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিন সরবরাহকৃত ‘কৃষিপণ্যের সর্বনিন্ম ও সর্বোচ্চ যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ’ করে দৃশ্যমান করা হয়েছে? এছাড়াও, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কৃষকদের দামে ঠকাচ্ছে কি-না সেই বিষয়ে কোন মনিটরিং বা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? এসব প্রশ্নের কোন উত্তর তিনি দেননি।

চিতলমারী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সিফাত-আল-মারুফ জানান, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর টমেটোর উৎপাদন ও চাষাবাদের পরিধি বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ১৯ হাজার টমেটো চাষী রয়েছেন। চলতি বছর ৮৩৯ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষাবাদ হয়। হঠাৎ করেই টমেটোর বাজারদর কমে যাচ্ছে। ফলে ১৯ হাজার টমেটো চাষীসহ তাঁর পরিবার সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হন। কৃষির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে যাঁরা লাভবান করছেন এবং প্রতিদিন যাঁরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন সেই কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় তারা সরব রয়েছেন বলে জানান।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *