চীন-ভারতের মুখোমুখি অবস্থান ও কিছু কথা

ফাইল ছবি

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চীন বানিজ্যে নিজেদের এখন বলা যায় বিশ্বে self Actualization পর্যায়ে নিয়ে গেছে। উন্নত বিশ্বের জন্য Prime Product quality, মধ্যম আয়ের দেশের জন্য Regular Product quality আর নিম্ন আয়ের দেশের জন্য Economy Product quality এক দারুণ ব্যবসায়িক পদ্ধতি তারাই বিশ্বকে দেখিয়েছে এবং জয় করছে তিন স্তরের বাজারই। তারাই সম্ভবত  Marketing Management by Philip Kotlar এর 4P’কে বেশী ধাতস্থ করেছে।

কোভিড-১৯ এর পর সবাই যেভাবে চীন বিষয়ে গেলো গেলো রব তুলেছিলো তা বাস্তবিক অর্থে নির্বুদ্ধিতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং আরও হবে। বিশ্বের প্রথম সারির কোন প্রতিষ্ঠানই চীন থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়া এখন এক প্রকার অসম্ভব৷ চীনের মত কাঁচামালের ব্যপ্তি বিশ্বের অন্য কোন দেশেই নেই! তার সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের আধুনিক প্রযুক্তি। চীনের মত দক্ষ শ্রমিকও পাওয়া অসম্ভব অন্য যেকোন দেশে। বলা হয়ে থাকে, চীনে যে পরিমানে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রমিক আছে তা সমস্ত বিশ্বের কারিগরি শিক্ষিত শ্রমিকের থেকে কয়েক গুণ বেশী। তাদের শিক্ষার্থীদের বিশাল একটা অংশ যারা অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী তারা স্কুল পাশ করে উচ্চতর পড়লেখার পথে না হেটে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে দুই তিন বছরের ডিগ্রি নিয়ে পেশাগত জীবনে চলে যায়। এর যে মাত্রাতিরিক্ত সুফল তা কিন্তু একমাত্র চীনই উপভোগ করছে। যা রাতারাতি কোন দেশের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এছাড়াও সারাবিশ্বে একচেটিয়া রপ্তানি আয়ের সুবাদে তাদের রিজার্ভ ফুলেফেঁপে কুবেরের ধনে পরিণত হয়েছে৷ অর্থ লগ্নির ক্ষেত্রে আছে অবাধ ক্ষমতা।

এই কোভিড-১৯ চলাকালীনই বিশ্বের পুঁজিবাজারে যে ধস নেমেছিলো তাতে যেসব দেশের পুঁজিবাজারে চীনের বিনিয়োগ আছে তার প্রায় সব দেশেই তারা বড় বড় কোম্পানির উল্লেখযোগ্য শেয়ার কিনে নিয়েছে পানির দরে। কোভিড-১৯ থেকে বিশ্ব পরিত্রাণ পাওয়ার সাথে সাথে বিশ্ব পুজিবাজারে মাত্র ২% উন্নতি হলেই, চীনের কোভিড-১৯ চলাকালীন অর্থনৈতিক সমস্ত ক্ষতি পুষিয়ে ট্রিলিয়ন ডলার লাভের মুখ দেখবে তাদের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা গুলো।

ইউরোপ ও আমেরিকায় Boycott China  নামে একটি ক্যাপ এখন সব থেকে জনপ্রিয় ক্যাপ। ধারণা করা হয় গত চার মাসে ইউরোপ ও আমেরিকায় এই ক্যাপ বিক্রি হয়েছে ত্রিশ কোটির উপরে। ক্যাপ এর মধ্যে লেখা Boycott china. মজার ব্যাপার হল এইসব ক্যাপই চায়নার তৈরি এবং শুধু মাত্র ক্যাপ বিক্রি করেই চীন মিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে গত চার মাসে৷ এটাই হল চায়না৷ তাদের সস্তা আবেগ কম। তারা সবখানেই ব্যবসা খুঁজে। তাদের গালি দিলে যদি তারা ডলার পায় তবে তাদের গালি দেয়ার জন্যই আপনাকে উৎসাহিত করবে।

ভারত চীন সম্পর্কে গত কিছুদিন থেকে ভারতীয় মিডিয়া ও কিছু হীনজ্ঞান সম্পন্নদের মধ্যে একটা হাস্যকর কথাবার্তা চালাচালি হচ্ছে। ভারত চীন যুদ্ধ হলে কি হবে, কে জিতবে, কে হারবে এইসব। কোন যুদ্ধই শুধু অস্ত্র দিয়ে তাও ভারতীয় তৃতীয় শ্রেণি মানের সেনাবাহিনী দিয়ে জয় করার স্বপ্ন দেখা সম্পূর্ণ অবাস্তব। ভারত শুধু বর্বর পাকিস্তানের সাথে লাফালাফি করতে পারবে, দুইজন মরবে তিনজনকে মারবে এই ধরনের কিন্তু আজ পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে জঙ্গি প্রবেশই আটকানোর ক্ষমতা দেখাতে পারলোনা। আর উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একাত্তরের ঋণের কারণে যে সম্মানটা দেখায় তা ভারত দুর্বলতার চোখে দেখে।

চীনের সাথে বড় ও দীর্ঘদিনের যুদ্ধে ভারত কোন ক্ষমতায় বা সাহসে যাবে?  ভারতের জিডিপির পাঁচ গুন বেশী জিডিপি চীনের না আমাদের মত ভুয়া জিডিবি না চায়নার কিন্তু। রিজার্ভ ভারতের থেকে প্রায় দশ গুনের বেশী৷ পেট্রলিয়াম রিজার্ভের তো তুলনাই চলে না। আমরা যারা ভারতে চিকিৎসার জন্য যাই তারা হয়ত জানিই না ভারতের ঔষধের ৭০% সরাসরি চীন থেকে আমদানি করা হয়। আর দেশে প্রস্তুত হয় এমন ঔষধের কাঁচামালের ৯০% চীন থেকে আনা হয়। এই সত্তর শতাংশ ঔষধ চীন থেকে না আনলে এবং কাঁচা মাল অন্য দেশ থেকে আনলে ভারতের চিকিৎসা ব্যায় যে হাল হবে তাতে কারো চিকিৎসা করার সামর্থ্য ভারতের অর্থনীতির নেই। বলা হয় সামান্য প্যারাসিটামল এর কাঁচা মাল চীন থেকে না আনলে ভারত তা বানাতে পারবে না বর্তমান মুল্যে। চীনের সাথে সামান্য উত্তেজনাতেই ভারতের ঔষধের দাম গত পনের দিনে ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে তথ্য- আনন্দবাজার।
আইটি, প্রযুক্তি, তথ্য,সেবা, উন্নয়ন সব সেক্টরেই চীনের বিশাল বিনিয়োগ ভারতে। ভারতের ১০০ কোটি ডলারের উপরের ত্রিশটি কোম্পানির মধ্যে ১৮ টির বিনিয়োগের মুল অংশই চীনের৷ মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠান গুলোতে যস চীনের বিনিয়োগ তার হিসাবই নেই।ভারতের সরকার পর্যন্ত চীনের থেকে বড় অংকের ঋণে আটকানো।

ভারত যদি জাতীয়তাবাদের চরম আকার ধারন করে চীনের পর্ণ বর্জনও করে তবে তা মাত্র ৩০% বর্জন করতে পারবে৷ এর বেশী করলে ভারতের ৮০% কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তথ্য – হিন্দুস্তান টাইমস,

হিসেব করে দেখা যায় যে ভারত থেকে কোন পণ্য আমদানি না করাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেলেও টিকে থাকবে। কিন্তু ভারতবর্ষে চীন থেকে কাঁচামাল ও প্রযুক্তির সুবিধা না আসলে এক মাসও ঠিকতে পারবে না ভারতের অর্থনীতি।

প্রতিবছর দুনিয়ার সব দেশ থেকে অস্ত্র কিনে জড়ো করলেই যুদ্ধে যাওয়া যায় না। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড লাগে, সেনাবাহিনীর দক্ষতা লাগে। যার কোনটিই চীনের ধারে কাছেও নেই। খুব বেশী হলে ভারতের জাতিয়তাবাদের মুখে চুনকালী বাচানোর জন্য একদুই মাসের যুদ্ধ করতে পারে সীমিত পর্যায়ে এবং দিন শেষে আকসাই এর মত আরেকটি বড় অংশ চীনকে উপহার দিয়ে মাফ চেয়ে বিদায় নিবে। ভারত প্রায় সব দেশের সাথে সীমান্তে ঠেলাঠেলি লাগিয়ে রাখলেও ১৯৪৭ এর পর থেকে এখন পর্যন্ত চীন ও পাকিস্তানের কাছে নিজেদের ভুখন্ডের ৪৩ হাজার বর্গমাইল জায়গা হারিয়েছে।

বাংলাদেশ ভারতের উপর যতটা নির্ভরশীল তার থেকে কয়েক গুন বেশী ভারত চীনের উপরে।

রাশেদ আলম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী  

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *