তারুণ্যের চোখে বিজয়ের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অর্ধশত

ইতিহাসের শত বছরের শোষিত জাতির নাম বাঙালি জাতি৷ যুগে যুগে নানা শাসকগোষ্ঠী দ্বারা শোষণের পর ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে বাঙালির নবজীবনের সূচনা হয়। আমরা পাই লাল সবুজের এই পতাকা। আর এই স্বাধীন দেশ। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।

বিশ্বের বুকে আবির্ভূত হয় একটি জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই বাংলাদেশের আছে নানা অর্জন, আছে নানা চ্যালেঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল দেশের তরুণ সমাজ। বিজয়ের প্রায় অর্ধশত বছরের দাঁড় প্রান্তে এসে তরুণরা কি ভাবছে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার এই বিজয় নিয়ে? বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর ভাবনা ও মতামত নিয়ে লিখেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।

আমজাদ হোসেন হৃদয় বিজয়ের পরিপূর্ণ সুফল কাম্য করেন। তার মতে বিজয়ের ৪৯ বছর পরও আমরা পরিপূর্ণ সুফল পাচ্ছি না। আমাদের এই বিজয় কেবল একটি জাতীয় পতাকা বা স্বাধীন একটি ভূখন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং বৈষম্যহীন দেশ গঠনের প্রেরণা এই বিজয়।

মুক্তিযুদ্বের মূলনীতি ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। সুদীর্ঘ ৪৯ বছর একটি জাতির জন্য কম সময় নয়, কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ে দেশের মানুষ যে জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল সেই বাক স্বাধীনতা, সেই ভোটাধিকার, শিক্ষার সঠিক পরিবেশ, জন নিরাপত্তা আজও সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানুষের মৌলিক অধিকার।

আমাদের শাসকরা এখন পর্যন্ত জনগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে নি। ব্যক্তি স্বার্থ ও দলীয় মতের উর্ধ্বে উঠে দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করা নেতার শাসন এখনো অধরাই রয়ে গেল। ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্রসংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য ও প্রশ্ন ফাঁস শিক্ষাখাতে কাঙ্ক্ষিত অর্জনকে বাধাগ্রস্থ করছে। দেশজুড়ে মাদকের ছড়াছড়ি তরুণ সমাজকে অন্ধাকার জগতে ঠেলে দিচ্ছে। সর্বোপরি স্বাধীনতার সম্পূর্ণ সুফল পেতে আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজানা আলম নির্জনা মনে করেন অর্ধশত বছরেও ধমকে আছে বিজয়।

বিজয়ের আজ অর্ধশত বছর। এ যেনো প্রতিটি বাঙালির নিকট বাধভাঙ্গা বিজয়োল্লাস। বিজয় মানে সম্পূর্ণরূপে জয়, পূর্ণ অধিকার। আর সেই বিজয় লাভের সুখটা তখনই অনুভব করা যায় যখন বহু কষ্টে কোনো কিছু অর্জিত হয়।

লাখো শহীদ তাদের রক্তের বিনিময়ে বিজয় করে নিয়েছিলো আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশকে। পরাধীনতার হাত থেকে দেশমাতৃকাকে বাঁচাতে নিজের সম্মান বিলিয়ে দিতে হয়েছে লাখো নারীকে। এই বিজয় গৌরবের, আনন্দের। কিন্তু আজ ৫০ বছরেও আদৌ কি সেই বিজয় পেয়েছে দেশের মানুষ?

দেশ বিজয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানুষ গুলো আজও সেই বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি। আজও প্রিয় জন্মভূমি দুর্নীতি, চোরাবাজারি, রাজনৈতিক কলহ, দারিদ্র্যতার কালোছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পদানত হোক অপশক্তি, মুছে যাক দারিদ্রতা, দূর হোক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, হাসি ফুটোক বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে। এগিয়ে যাক প্রাণের দেশ বাংলাদেশ।

রওশন জাহান সুমাইয়া অধ্যায়ন করছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার স্বপ্ন একটাই, দেখতে চান আলোকিত বাংলাদেশ।

বিজয় মানে কখনো অর্জন, কখনো উল্লাস, কখনো বা নিজেদের অবস্থান তৈরী করা। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়েছি।

বিশ্বের বুকে নিজেদের মানচিত্রের নকশা গড়েছি। তার উল্লাসেই আমরা বিজয় দিবস পালন করি। ৩০ লক্ষ শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচয় পেয়েছি সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব ও আমাদের। কেননা স্বাধীনতা অর্জন এর চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা কঠিন।

দেশের নাগরিক হিসেবে বিজয় দিবস পালন যেমন আমাদের অধিকার তেমনি দেশের প্রতি আমাদের কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য ও রয়েছে। সবাই নিজ নিজ অবস্থানকে মজবুত করে দেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরার মাধ্যমে সে দায়িত্ব ও কর্তব্য পরিপূর্ণ করতে হবে। এ দেশে সুশাসন, নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য সুষ্ঠভাবে পালন, গুণগত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া ও তরুণ প্রজন্মকে শক্তিতে রূপান্তর করার মাধ্যমে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব৷ আয়নায় যেমন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় ঠিক সেভাবে নিজেদের সামাজিক কাজ করার ইচ্ছা, দেশ এবং মা-বাবা কে গর্বিত করার অদম্য ইচ্ছাকে জাগ্রত করে বাস্তবায়িত করলেই আমাদের বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এই প্রত্যাশা।

দেশমাতৃকার সেবাই হোক বিজয় দিবসের অঙ্গীকার, এমনটাই চান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোকনুজ্জামান।

বিজয় দিবসের জমকালো আনুষ্ঠানিকতার বাইরে আমরা কি পেরেছি বিজয়ের উদ্দেশ্যকে হৃদয়ে লালন করতে?

দীর্ঘ ৪৯ বছরেও কি যোগ্যতা অর্জন করেছি মাথা উঁচু করে গর্ব করতে পারার? অথচ দ্বায়িত্বগুলো আমাদের তরুণদের উপরেই অধিক পরিমাণে বর্তায়। তরুণ প্রজন্মের প্রত্যেককে দেশের একেকজন সেচ্ছাসেবক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। সে চেষ্টার শুরুটা হওয়া উচিৎ ব্যক্তি পর্যায় থেকেই। তরুণরাই পারে এ দেশের হাল ধরতে।

দেশে সুশাসন, নাগরিকের দায়িত্ব কর্তব্য সুষ্ঠভাবে পালন, গুণগত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া ও তরুণ প্রজন্মকে শক্তিতে রূপান্তর করার মাধ্যমে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া সম্ভব৷ আর এতেই স্বার্থকতা লাভ করবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত। সার্থকতা লাভ করবে স্বাধীনতা। অন্যথায় এ বিজয় অর্থহীন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বিজয়ের স্বরূপ তুলে ধরতে দেশমাতৃকার সেবাই হোক আমাদের বিজয় দিবসের অঙ্গিকার।

বিজয়ের চেতনাই হোক পথ চলার শক্তি, যে শক্তিতে অনুপ্রেরণা পান মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক।

বিজয় মানে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লক্ষ শহীদের জীবনাবসান, ২লক্ষ ৭৬ হাজার মা-বোনের ইজ্জতের সংমিশ্রণ আমাদের বিজয়। যেই পথ পরিক্রমায় সামনের সারিতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তরুণদের। জীবনের বিশাল সময় রয়েছে পড়ে, সোনালী ভবিষ্যৎতের আছে হাতছানি তাও দমে যান নি তরুণেরা।

অন্যায়, অবিচার তথা পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন অবিরাম। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে জনতার সাথে, গড়ে তুলেছে “মুজিব বাহিনী”। ধ্বংস করেছে হানাদার বাহিনীর একের পর এক পরিকল্পনা। কষ্টার্জিত এই বিজয় তাই আমাদের অস্তিত্ব, এগিয়ে যাবার প্রেরণা। কোনভাবেই অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই মহান মুক্তিযুদ্ধের।

বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক সেই চেতনা বা দেশান্তবোধ এটাই চির প্রত্যাশা। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের করা হোক অপসারণ, অপশক্তিকে করা হোক পদানত, সৃষ্টি হোক ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর বাংলাদেশ। এগিয়ে যাক প্রিয় মাতৃভূমি।

মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন হোক, এমনটাই চান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুস সবুর লোটাস।

বিজয় শব্দটা শুনলেই আনন্দ লাগে। যে কোন বিজয়ই সাধারণভাবে আনন্দের হয়। তবে বিজয়ের পিছনে থাকে বৃহৎ সংগ্রামের ইতিহাস৷

ডিসেম্বর আসলেই মনের ভেতরে বিজয় দিবসের আনন্দের বাতাস বইতে থাকে। এই আনন্দের জন্য প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবন দিতে হয়েছে। যার মধ্যে অনেক শিশু আছে৷ অনেকে তাদের সর্বস্ব হারিয়েছেন। তাদের এই প্রতিদানের ফলে আমরা পেয়েছি এই সবুজ-শ্যামল ভূখন্ড।

এই বিজয়ের জন্য যারা জীবন দিয়েছে সবাই পাকিস্তানের অন্যায়, অত্যাচার, দুশাসন থেকে মুক্তির জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিলো ধর্ম নিরপেক্ষ, ক্ষুধা ও বৈষম্যহীন একটি সুন্দর দেশের। তাদের আকাঙ্ক্ষা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। আমরা সেই বীরদের আত্মত্যাগের কথা কোনোদিন ভুলব না। গভীর শ্রদ্ধায় আমরা তাদের স্মরণ করবে।

সারাজীবন আমরা যেনো তাদের আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ সম্মান করতে পারি সে দিকে সকলের সচেষ্ট হতে হবে। সেই সাথে দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হোক এদেশে এটাই চাই।

 

 

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *