প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিস্ময়কর ১২ টি প্রযুক্তি

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ।প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রাণ হারায় ভয়াবহ এই যুদ্ধে ।বর্তমান সময়ের মত প্রযুক্তিতে এত এগিয়ে না থাকলেও সেই সময়ে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারও কম ছিল না । যে দেশ যত বেশি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করত সে ততো বেশি এগিয়ে থাকত।

১। ট্যাংক

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্ব প্রথম দেখা মেলে ট্যাংক বা স্থলযুদ্ধ জাহাজের । প্রথম ট্যাংক দ্য ব্রিটিশ মার্ক আই। ট্যাঙ্কটি নকশা করা হয় ১৯১৫ সালে এবং প্রথম যুদ্ধের মুখ দেখে ১৯১৬ এর সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের সাথে সম্মপে এলাকায় । ফরাসিরা খুব দ্রুতই ব্রিটিশদের মতো সাঁজোয়া ট্যাংক  রেনাল্ট এফ টি বানিয়ে ফেলে ।বলা যায় এটিই ছিল প্রকৃত ট্যাঙ্ক । ফরাসি রা গাড়ির উপরে এক ধরনের মঞ্চ বসায় ছিল যা ঘুরতে পারত ।যুদ্ধে ব্রিটিশ ও ফরাসিদের ট্যাংক নামালে জার্মানরাও যুদ্ধযান তৈরির প্রতিযোগিতায় নামে । এ৭ভি নামে তারা উদ্ভট দেখতে একটি ট্যাংক তৈরি করে ফেলে।

1918 Mark V Tank Interior – প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ

 

২। ট্রেসার বুলেট

গ্রেট ওয়ার বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেক বিরুপ পরিবেশে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হত । কিন্তু রাতে লড়াই করা ছিল সবথেকে খরুচে ও অনর্থক । কারণ আপনি কোথায় শুট করছেন তা দেখার কোন উপায় ছিল না । ব্রিটিশরা ট্রেসার বুলেট আবিষ্কার করে ব্যাপারটাকে অনেকটাই সহজ করে ফেলে । মূলত বুলেট থেকে জ্বলনযোগ্য এক ধরনের উপাদান বা গ্যাস বের হতো যা ফসফরেসেন্ট ট্রেল ধরে রাখতে পারত। যদিও ১৯১৫ সালের ব্যবহৃত বুলেট টি সক্ষমতা ছিল মাত্র ১০০ মিটার পর্যন্ত । ১৯১৬ সালে এটিকে আরও উন্নত করা হয়।

৩। ইনটেরাপ্টার গিয়ার

১৯০৬ সালে বিমান আবিষ্কারের পর থেকেই বিমান নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলতে থাকে। কিন্তু আকাশপথে উড়োজাহাজের সাথে বোমা কিংবা মেশিনগান কিভাবে ব্যবহার সম্ভব তা বোঝা মুশকিল হচ্ছিল । কারণ প্রপেলারের ব্লেড গুলো সামনে চলে আসছিল। আমেরিকান আর্মি প্রথমবার চেষ্টা করে একটি মেশিনগান উড়োজাহাজের সাথে বেঁধে চালানোর কিন্তু মেশিন গান চালানোর জন্য আরও একজন লোকের প্রয়োজন ছিল। তারপরও এটির সঠিক ব্যবহার হচ্ছিল না । ডাচ বিজ্ঞানী এন্টনি ফোকার প্রথমবারের মতো প্রোপেলারের সাথে মেশিন গানের গুলি ছোড়ার বিষয়টা সমন্বয় করেন । পরবর্তীতে জার্মানরা সহ অন্যান্য দেশ তাদের নিজেদের মতো করে ইনটেরাপটার গিয়ার বানিয়ে ফেলে।

৪। ফ্লেমথ্রোয়ার 

আধুনিক ফ্লেমথ্রোয়ারের প্রথম নকশাটি ১৯০১ সালে জার্মান সেনাবাহিনী কে রিচাড ফিডলার তৈরি করে দেন। ১৯০১ সালে জার্মানরা বিভিন্নভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে । যুদ্ধক্ষেত্র শত্রুপক্ষে হামলা চালালে দেখা যায় যে শত্রুপক্ষের সৈন্যদল ট্রেঞ্চ বা খাদ এর আশেপাশে কিংবা বাংকারে লুকিয়ে যায় । এই সমস্যা দূরের জন্য ফ্লেমথ্রোয়ার ব্যবহার হয়। এর সাহায্যে পিঠে নাইট্রোজেনের ট্যাঙ্ক বহন করে সরু নজেল এর মাধ্যমে তা নির্দিষ্ট দিকে স্প্রে করা যেত । ১৯১৫ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি জার্মানরা প্রথম এটি ব্যবহার করে ভারদুনের কাছে,ফ্রান্সে ।

৫। রাসায়নিক বা বিষাক্ত গ্যাস

যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই ভয়াবহ রকমের ক্ষতি করে এই বিষাক্ত গ্যাস। জার্মানরা বলিমভের যুদ্ধের সময় ৩১ জানুয়ারি ১৯১৫ সালে রাশিয়ায় এই আক্রমণ করে। কিন্তু স্বল্প তাপমাত্রা বা ঠান্ডার কারণে শেলগুলি হিমশীতল হয়ে যায় । তবে সফল ভাবে ১৯১৫ সালের ২২ এপ্রিল বেলজিয়ামের ওয়াইপ্রেসে জার্মানরা কামানের গোলায় ক্লোরিন গ্যাস ভর্তি করে ব্যবহার করে। অন্যান্য দেশও নিজেদের রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় নামে।

 ৬। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী জাহাজ

স্কোয়াড্রন কমান্ডার এডোয়ার্ড ডানিং প্রথম ব্যক্তি যিনি চলন্ত জাহাযে বিমান অবতরণ করাতে সফল হন ।১৯১৭ সালের ২ আগস্ট বিমানবাহী জাহাজ ফিউরিয়াসে বিমান অবতরণ করাতে সক্ষম হন । ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা এটি তৈরি করেছিল যা ছিল ৭৮৬ ফুট লম্বা একটি বিমানবাহী জাহাজ।এটি ছিল মূলত একটি রণতরী এবং এতে দুটো ১৮ ইঞ্চি বন্দুক ছিল ।কিন্তু তারা যখন বুঝল বিশালাআকার বন্দুকের ঝাকুনিতে জাহাজের ক্ষতি হচ্ছে তখন তারা এর বিকল্প ব্যবহার করা যায় কিনা তা ভাবা শুরু করল । উড্ডয়ন ও অবতরণ এর জন্য লম্বা পাটাতনের ব্যবহার করল। বিমানের রানওয়েতে যাতে বেশি জায়গা থাকে তাই রানওয়ে এর নিচে হ্যাংগার রাখা হয়েছিল । যা বর্তমান সময়ের আধুনিক বিমানবাহী জাহাজেও দেখা যায় ।

৭। প্যাডেল ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিদ্যুতের ব্যবহার কিংবা উৎপাদন তখন এতটা ভালো ছিল না । কিন্তু যুদ্ধের সময় বিভিন্ন সংগত কারণেই বিদ্যুতের অনেক প্রয়োজন ছিল । বিশ্বযুদ্ধে প্রধানত নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার্থে বিদ্যুতের দরকার বেশি ছিল । কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পক্ষে তো আর চাইলেই বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো সম্ভব না। তাই জার্মান বিজ্ঞানীরা নতুন এক উপায় বের করল । তারা সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে প্রয়োজনমতো বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করল । তো এই কাজের জন্য সব সময় দুইজন সৈনিক প্যাডেল নিয়ে ব্যস্ত থাকত । আর সাইকেল গুলো তৈরি হয়েছিল এমন ভাবে যাতে একসঙ্গে দুইজন তা চালাতে পারে।

৮। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার

বিমানের ব্যবহারের শুরুর দিকে কোন বিমান একবার মাটি ত্যাগ করলে স্থলের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। পতাকা,আলোর ব্যবহার ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না । আমেরিকার আর্মিই প্রথম যারা বিমানে প্রথম রেডিও স্থাপন করে । তারা এ রেডিওর মাধ্যমে উভয়মূখী যোগাযোগে সক্ষম হয় । ১৯১৫ সালে সানডিয়েগোতে এটি প্রথম তৈরি হয় । টেকনিশিয়ানরা  ১৯১৬ সালে ১৪০ মাইল দূরে বার্তা পাঠাতে সক্ষম হন । এর মাধ্যমে ১৯১৭ সালে স্থলে থাকা অপারেটরের সাথে উদীয়মান বিমানের পাইলট কথা বলা সম্ভব হয় ।

৯। স্যানিটারি ন্যাপকিন

ঐতিহ্যগতভাবেই মহিলারা রজঃস্রাবের জন্য ধোয়া যায় এমন কিংবা বারবার ব্যবহার করা যায় এমন কাপড় ব্যবহার করে আসছেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেলুলোজ ব্যান্ডেজ আবিষ্কার হয় । এটি মূলত সৈনিকদের কাজে লাগতো । পরিষ্কারের জন্য ব্যান্ডেজ আহত স্থানে ব্যবহার করা হতো কারণ এর শুষে নেয়ার ক্ষমতা অন্যান্য তৎকালীন ব্যান্ডেজের থেকে অনেক বেশি ছিল । পরবর্তীতে  ফরাসি নার্সরা এটির ব্যবহার শুরু করে তাদের নিজেদের জন্য । দ্রুতই ব্রিটিশ ও আমেরিকার নার্সরা এর ব্যবহার শুরু করে । আমেরিকার কর্পোরেট কোম্পানি কিম্বারলি-ক্লারক  ১৯২০ সালে বাণিজ্যিকভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন বাজারে আনে । যার নাম ছিল কোটেক্স অর্থাৎ কটোন ও টেক্সচারের মিলিত রূপ ।

১০। মোবাইল এক্সরে মেশিন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একদিকে যেমন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ সৈনিক গুরুতর আহত হচ্ছে । রোগ নির্ণয় বা নিরাময়ের জন্য অত্যাধুনিক কোনো যন্ত্র তখন ছিল সময়ের দাবি । তৎকালীন সময়ে যেসব এক্সরে পাওয়া যেত তা ছিল ভারি আর খুবই নাজুক । যেগুলো নিয়ে চলাচলে নানাবিধ সমস্যা হতো । মেরি কুরি, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই ফরাসি সামরিক বাহিনীর জন্য মোবাইল স্টেশন তৈরির কাজ শুরু করে দেন । ১৯১৪ এর অক্টোবর এর মাঝামাঝিতে তিনি বেশ কয়েকটি গাড়ি ও ছোট ট্রাক গুলিতে মেশিন স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন । যা দিয়ে যুদ্ধস্থানের মেডিকেল ক্যাম্পে সহজেই কাজ চালানো যেত । ফ্রেডরিক জোনস ১৯১৯ সালে আরো ছোট পোর্টেবল এক্সরে মেশিন তৈরিতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

১১। চালকবিহীন ড্রোন

মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য প্রথম পাইলটবীহিন ড্রোন তৈরি করা হয়েছিল । ১৯১৬ ও ১৯১৭ সালে দুই উদ্ভাবক এলমার স্পেরি ও পিটার হিডট মানবহীন বিমান তৈরী করে। যা ছিল মূলত প্রোটোটাইপ ক্রুস ক্ষেপণাস্ত্র । ১৮৫ ফুট উঁচুতে ১২ অশ্বশক্তির মোটর যার ওজন ছিল ১৭৫  পাউন্ড । এতে  গাইরোস্কোপ ও ব্যারোমিটার সংযুক্ত করা হয়েছিল । তবে ইতিহাসের প্রথম মানবহীন বিমান ১৯১৮ সালের ৬ মার্চ লং আইল্যান্ডে অবতরণ করে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে এর তেমন ব্যবহার হয়নি কারণ এটি দ্বারা লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণ করা ছিল খুবই কঠিন ছিল ।

১২। হাইড্রোফোন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডুবো জাহাজের বা সাবমেরিন এর ব্যবহার ছিল লক্ষ্য করার মতো। সেই সময় কেউ যদি সাউন্ড ওয়েভ এর ব্যবহার করে সাবমেরিন শনাক্ত করতে পারত তা ছিল খুব বড় ব্যাপার । প্রথম হাইড্রোফোন ১৯১৪ সালে কানাডার উদ্ভাবক রেজিনাল্ড ফ্যান আবিষ্কার করেন । তিনি মূলত টাইটানিক বিপর্যয়ের পর বড় আইসবার্গ বা বরফখণ্ড শনাক্তের জন্য এটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু এর ব্যবহার ছিল সীমিত । এটি শুধুমাত্র কোন বস্তুর দূরত্ব বলতে পারত; দিক নয় । পরবর্তীতে ফরাসি বিজ্ঞানী ল্যংভিন ও রাশিয়ান চিলোভস্কি পাইজোইলেকট্রিসিটি এর উপর নির্ভরশীল হয়ে আল্ট্রাসাউন্ড ট্রানসডুসার আবিষ্কার করেন । দুটো ধাতব প্লেট এর মধ্যবর্তী কোয়ার্টাজরের পাতলা স্তরে জলচাপের ফলে যে ক্ষুদ্র পরিবর্তন হয় তা দিয়েই জলের নিচের বস্তুর দিক ও দূরত্ব নির্ধারণ করা হয় । এই হাইড্রোফনিক সফলভাবে ১৯১৬ সালের এপ্রিলে একটি সাবমেরিন শনাক্ত করতে সক্ষম হয় ।

সেই প্রায় ১০০ বছর আগের এই বিধ্বংসী  অস্ত্রগুলো আমাদের এই আজকের অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে ঠিকই কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে এই নিত্য নতুন অস্ত্র আবিষ্কার কি মানবজাতির জন্য কখনো সুফল বয়ে আনতে পেরেছে !!

 

সোর্সঃ https://www.mentalfloss.com/

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *