বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ও বাংলাদেশে অটিজম ও স্নায়ু-বিকাশজনিত সমস্যা বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন, মিজ সায়মা ওয়াজেদ এর পরার্মশ ও নিরলস প্রচেষ্টায় অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে যেমন সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তেমনি এসব শিশু ও ব্যক্তির জন্য নানাবিধ র্কাযক্রম বাস্তবায়ন করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২রা এপ্রিল রবিবার সকাল সাড়ে ১০ টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ১৭তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় মন্ত্রী ডা.দীপু মনি বলেন এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, এনডিডি ব্যক্তিগণের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে তাঁদের সার্বিক অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ প্রণয়ন। এ আইনের বিধান অনুসারে ২০১৪ সনে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট স্থাপন। তাদের সেবকদের মানদন্ড,সেবকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানদন্ড এবং সেবা প্রতিষ্ঠানের মানদন্ড নির্ধারণ ও পরিচালনা করতে ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটিশেন কাউন্সিল আইন,২০১৮’প্রণয়ন করেছি; যাতে তাঁরা গুণগত সেবা পেয়ে স্বাভাবিক মানুষের মত চলাফরো করতে পারে। এই এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিকে বিশেষায়িত শিক্ষা দিয়ে জীবনমূখী করে পরিবারের, সমাজের তথা রাষ্ট্রের বিনির্মাতা করে গড়ে তুলতে ‘প্রতিবন্ধিতা সর্ম্পকিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০১৯’ প্রণয়ন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনে বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত এই এনডিডি শিশু ব্যক্তিরা অনবদ্য অবদান রাখতে পারে।
তিনি আরো বলেন, অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার এবং অন্যান্য নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশুদের সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিসংঘের উদ্যোগে এ দিবস প্রতি বছর সরকার যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে। এই সব প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয়ে সরকারী ও বেসরকারী সমম্বিত উদ্যোগ গ্রহণে বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাব জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে ২০১২সালের ১২ ডিসেম্বর গৃহীত হয়। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি একটি ঐতিহাসিক স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা মিজ সায়মা ওয়াজেদ দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজমসহ নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল বিষয়ক কার্যক্রমকে সংগঠিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরই উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার এই প্রস্তাব দেয়। তাঁর উৎসাহে এবং পরামর্শে অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ব্যক্তিদের সম্পর্কে আমি ধারণা পাই ও কাজ করতে আগ্রহী হই। আমরা তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে বাস করছি। দেশ এখন শতভাগ ডিজিটাল। প্রচলিত গণমাধ্যমের বাইরেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমরা তৎক্ষণাৎ দেশে বিদেশের খবরা খবরসহ অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারি। ইন্টারনেটের ওপেন সোর্সের মাধ্যমে আমরা অটিজমসহ স্নায়ুবিক অন্যান্য ডিজঅর্ডার সম্পর্কে জেনে সচেতন হতে পারি। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,অটিজম বিষয়ক গবেষক,চিকিৎসকের বাইরেও ব্যক্তিগত বা সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে পারি। একটি শিশুর বিকাশের প্রথম দিকেই যদি বাবা মা বা তার অভিভাবক বুঝতে পারে তার শিশুটির স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতা রয়েছে তাহলে তার চিকিৎসা,পরিচর্যা,জীবন ধারণ,বেড়ে উঠা অনেক সহজ হবে। অটিজম বা স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার থেকেও তারা রেহাই পাবে।
” সচেতনতা -স্বীকৃতি -মূল্যায়ন: শুধু বেঁচে থাকা থেকে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা” এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এবং এ প্রতিপাদ্যের গুরুত্ব ধারণ করে অটিজম বিষয়ে কাজ করতে হবে। অটিজম বিষয়ক সচেতনতা, সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। অটিজম বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিরাও দেশের অন্যান্য নাগরিকে মত সমান অধিকার ও সম্মান পায় সে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। তাদের যথাযথ পরিচর্যা,প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাদেরকে সমাজে টিকে থাকার মত সক্ষম করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের সামগ্রিক যে উন্নয়ন তা থেকে যেন একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও বাদ না যায় সে বিষয় লক্ষ রেখে সবাইকে কাজ করতে হবে। ২০৪১ সালে মধ্যে যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি,সেই সমৃদ্ধ বাংলাদেশে হবে অটিজমসহ সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর দেশ।
প্রতিবন্ধিতার ১২ টি ধরণে মধ্যে ৪টি প্রতিবন্ধিতা-অটিজম বা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডারস, ডাউন সিন্ড্রোম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা ও সেরিব্রাল পালসিকে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ।
তিনি বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত প্রতিবন্ধী সণাক্তকরণ জরীপ অনুযায়ী দেশে মোট শণাক্তকৃত প্রতিবন্ধীর সংখা ৩৩,৩৭,০৪২জন, যার মধ্যে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ৮৬,১৪২ জন।
সরকার অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন এবং আন্তর্জাতিক সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে সরকার অটিজমসহ স্নায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে ২০১৩ সালে “নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন” প্রণয়ন করে। এ আইনের বিধান অনুসারে ২০১৪ সালে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা,জীবনমান উন্নয়ন,আবাসন ও পুনর্বাসনের জন্য নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
এনডিডি ট্রাস্ট হতে এনডিডি ব্যক্তিদের এককালীন ১০,০০০ টাকা করে চিকিৎসা অনুদান প্রদান অতিদরিদ্র এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিকে বড় ধরণের চিকিৎসা ও থেরাপি সংক্রান্ত ব্যয়ের জন্য এনডিডি ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদনের ভিত্তিতে বিশেষ অনুদান প্রদান করা হচ্ছে । এনডিডি শিশু ও ব্যক্তির মাতা-পিতা ও কেয়ারগিভারদের প্রশিক্ষণ প্রদান;বিশেষ স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান; প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০১৯, প্রণয়ন করে এনডিডি শিশুদের সমন্বিত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা;এনডিডি শিক্ষার্থীদের উপযোগী শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে বিশেষ কারিকুলাম প্রণয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে এর গাইড লাইন প্রস্তুত করা হয়েছে; অটিজম সনাক্তকরণ ও মাত্রা নিরূপণের জন্য “স্মার্ট অটিজম বার্তা”ও ‘বলতে চাই’নামক এপস তৈরি করা হয়েছে।
এনডিডি ব্যক্তিদের সণাক্তকরণে স্ক্রিণিং টুলস প্রণয়ণের কাজ চলমান রয়েছে। এনডিডি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ‘বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা’চালু করা হয়েছে; এনডিডি এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্কুল/ প্রতিষ্ঠানসমূহ ডিজিটাল পদ্ধতিতে মনিটরিং এবং সেবা প্রদান; এনডিডি ব্যক্তিদের জন্য Job Fair এর আয়োজন ও কর্মে প্রবেশের জন্য সুযোগ সৃষ্টিকরণ; সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে ও স্থানীয় পর্যায়ে এনডিডি গুডউইল এম্বেসেডর নিয়োগ করা হচ্ছে। দেশের ১৪টি স্থানে‘অটিজম ও এনডিডি সেবাদান কেন্দ্র’ স্থাপন শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং দেশের ৮ বিভাগে ৮টি আবাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে গোটা বিশ্ব প্রতিবন্ধী বান্ধব ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতকরণে এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্টকে নূতন নূতন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে এবং আরও সক্রিয় হতে হবে যে,আমাদের সমাজভিত্তিক পূর্নবাসন সেবা র্কাযক্রমকে আরো গতিশীল করতে হবে। আমার বিশ্বাস,অটিজমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা,শিক্ষা,প্রশিক্ষণ ও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা হলে তারাও পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদ হিসাবে গড়ে উঠবে।অটিজমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু-ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ অন্যান্য সামাজিক অগ্রগতির ন্যায় রোল মডেলহিসাবে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পাবে। পরিশেষে আয়োজনে যারা অবদান রেখেছেন এবং যেসকল অটিজম ও এনডিডি মানুষ এবং তাদের আপনজন দূরদূরান্ত থেকে এসে এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছে, বিশ্বের সকল অটিজম ও এনডিডি ব্যক্তির জীবন ভরে উঠুক আনন্দে-এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান তিনি।