সরকারের উদ্দেশ্যে ১২ দফা দাবিসহ করোনাদুর্যোগ মোকাবেলা গণকমিটির খোলা চিঠি

ঝিনাইদহে
প্রতীকি ছবি

সরকারের উদ্দেশ্যে ১২ দফা দাবিসহ খোলা চিঠি দিয়েছে করোনাদুর্যোগ মোকাবেলা গণকমিটি।

মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে চলমান করোনাদুর্যোগ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে করোনাদুর্যোগ মোকাবেলা গণকমিটি সরকারের উদ্দেশ্যে ১২ দফা দাবিসহ নিম্নোক্ত খোলাচিঠি দিয়েছে:

বাংলাদেশ সরকারের উদ্দেশ্যে করোনাদুর্যোগ মোকাবেলা গণকমিটির খোলা চিঠি:

বৈশ্বিক মহামারি ও মারাত্মক ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাস থেকে জনগণকে রক্ষায় প্রয়োজন ছিল সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত প্রায় আড়াই কোটি পরিবারসহ দেশের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সমন্বিতভাবে সহযোগিতা প্রদান করে পরিপূর্ণ লকডাউন নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন, মাসে মাত্র এগার হাজার কোটি টাকায় এর ব্যবস্থা করা যেত। সরকারের পক্ষে তা করা কোন কঠিন বিষয় ছিল না। কিন্তু, আপনারা পুরোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিমাণ ও আওতা কিছুটা বাড়িয়েছেন মাত্র। সেখানেও হয়েছে লুটপাট। করোনাদুর্যোগে কর্মহীন-রোজগারহীন কোটি কোটি দরিদ্র শ্রমজীবী জনগণের জন্য নগদ সহায়তা, প্রণোদনাসহ সার্বিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য কোন সমন্বিত পদক্ষেপ আপনারা নেননি।

করোনায় নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনগণের সুচিকিৎসা তো বহু দুরের বিষয়, পত্রিকার পাতায় ছবিসহ খবর আসছে- করোনা পরীক্ষার জন্য রাত-দিন লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। টেস্ট করা যাচ্ছে না। হাসপাতালে বেড নাই। আইসিইউ নাই। চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। চিকিৎসার জন্য চারদিকে হাহাকার। পাঁচ মাসেও জনগণের জন্য পর্যাপ্ত ও কার্যকর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। চিকিৎসা না পেয়ে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। রাস্তার পাশে মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। করোনায় সংক্রমিত হবার বিষয় প্রকাশিত হলে নানাভাবে নিগৃহীত হবার শঙ্কায় মানুষ করোনাসংক্রমণের তথ্য নিজে থেকেই গোপন করছে। এমনকি অসহায়ভাবে মুখবুজে মৃত্যুকে হজম করছে।

অর্থনীতি তো কেবল বড় ধনী মালিকদের বিষয় নয়। শুধু বিদেশিদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য রপ্তানিরও বিষয় নয়। আমাদের জনসংখ্যার বিপুল অধিকাংশ মানুষের উৎপাদনসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড নিয়েই দেশের অর্থনীতি। কোটি কোটি কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, ক্ষুদে উৎপাদকদের উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডেই চলে দেশের জনগণের প্রয়োজন মেটানোর মূল অর্থনীতি। জনগণের এ অর্থনীতিকে রক্ষায় সরকার সমন্বিতভাবে সহযোগিতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়নি। আপনারা অর্থনীতির কথা বলে বড় বড় মালিক ও রপ্তানীকারকদেরকে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছেন। ঋণ মওকুফ করেছেন। অথচ, শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনগণের উপর নেমে এসেছে ঘরবন্দী বেকারত্ব, অনাহার, অবাধ সংক্রমণ, বিনাচিকিৎসায় মত্যু, ছাঁটাই, বেতন কর্তন, নজিরবিহীন বর্ধিত পরিবহণ ভাড়াসহ নতুন নতুন ব্যয় ও ক্ষতির বোঝা।

অর্থনীতির সবক্ষেত্রেই গুটিকয় বড় ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে দ্রুততার সাথে নানা পদক্ষেপ আপনারা নিয়েছেন। করোনায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও ব্যবসা করা হচ্ছে। শ্রমিকদের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়ে করোনার সুযোগে গার্মেন্টস মালিকদের স্বার্থ বড় করে দেখা হয়েছে। দেশে যখন পিপিই’র অভাবে স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যপকভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করছে সে সময় বেক্সিমকোর মত কোম্পানি লাখ লাখ পিপিই আমেরিকায় রপ্তানি করেছে। অথচ, গণস্বাস্থ্যের কিট, কেরু কোম্পানীর সেনিটাইজার, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সুলভ ও গণমুখী উদ্যোগগুলোকেও বাধা দেয়া হয়েছে। আর খুন, অপহরণ, লুন্ঠণের মত গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হলেও অতিধনীদের ভাড়া করা বিমানে দেশ ছাড়াসহ দায়মুক্তির আয়োজন অব্যাহত রয়েছে। যারা জনগণের পক্ষে ত্রাণসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেছেন, গণবিরোধী তৎপরতা নিয়ে সমালোচনা করেছেন তাদেরকে আটক ও কারারুদ্ধ করা হয়েছে।

গত তিন মাসে দেখা গেছে একদিকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি, অফিস কারখানা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ আবার অন্যদিকে এর মাঝেই গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী করাখানা খোলা, শ্রমিকদের শত শত মাইল হাঁটিয়ে এনে আবার হুট করে কারখানা বন্ধ। মন্ত্রীরাও বলেছেন, বাজার ধরে রাখতেই এ সিদ্ধান্ত। দোকানপাট শপিংমল খোলা আবার বন্ধ, যানবহন বন্ধ অথচ রাস্তা ঘাটে হাজারো মানুষের ঢল আবার ব্যক্তিগত যানবাহন চালু। এভাবে সরকারি পদক্ষেপের সমন্বয়হীনতার ফলে সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার সুযোগ তৈরি হয়েছে। লকডাউন অথচ লকডাউন নয়, বন্ধ অথচ বন্ধ নয়। সর্বত্র এমন সমন্বয়হীনতা প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে দেখা গেছে বড় বড় মালিকরা প্রয়োজনে সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ স্বার্থে সমগ্র দেশ ও জাতিকে জিম্মি করেছে। এসবে প্রকাশিত হয়েছে- কলকাঠি আসলে অতিধনীদের হাতে আর সরকার তাদের স্বার্থরক্ষক আজ্ঞাবাহীর ভূমিকা পালন করছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষকে রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু, পরিস্থিতিই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে, জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি শুধু নয় তাদের উপর নিত্য নতুন বোঝা চাপিয়ে অতিধনীদের স্বার্থ রক্ষায় আপনারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাইতো, সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা যখন সর্বাধিক সেসময় লকডাউন কঠোর করার পরিবর্তে অর্থনীতির কথা বলে আপনারা অফিস আদালত ব্যবসা-বাণিজ্য কারখানা ইত্যাদি খুলে দিয়েছেন। অর্থাৎ, জেনেশুনে লাখ লাখ মানুষকে অবাধ সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তারপর এর দায় খোদ জনগণের উপরে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন- মাস্ক না পড়লে লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকার কর্তৃক অর্থনীতি রক্ষার অর্থ যে মালিকদের সুবিধা নিশ্চিত করা তা প্রকাশিত হয়েছে- দুর্যোগে আয়রোজগারহীন মানুষের জন্য পরিবহণ ভাড়া ফ্রি করে দেবার পরিবর্তে মালিকদের লাভ ঠিক রাখার জন্য পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে। এখন আবার নতুন করে লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে। ঘটনা পরম্পরাই ইঙ্গিত দিচ্ছে, চারদিকে যোগাযোগ প্রবাহ রেখে সে লকডাউন হবে আদতে লোকদেখানো আয়োজন মাত্র।

আমরা করোনাদুর্যোগ মোকাবেলা গণকমিটি সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি, গুটিকয় অতিধনীদের স্বার্থে শ্রমিক কৃষকসহ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে বিনাচিকিৎসায় মহামারি, মৃত্যু ও অনাহারের দিকে ঠেলে দেবেন না। জনগণকে রক্ষার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসুন। তা নাহলে, আগামীতে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ফলে লাখ লাখ মানুষের সংক্রমণ ও হাজার হাজার মৃত্যু হলে তার দায় সরকারকে বহন করতে হবে।

আমরা মনে করি, জনগণকে রক্ষা করে কার্যককরভাবে করোনা মোকাবেলা করতে হলে কর্মহীনদের জন্য বেকার ভাতা, কর্মরতদের জন্য ঝুঁকি ভাতা, জনস্বাস্থ্যের জন্য সুচিকিৎসা ও সংক্রমণ রোধ, অর্থনীতির জন্য করোনা মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল, ছোট ও মাঝারি অর্থনীতির জন্য প্রণোদনার নিশ্চিত করতে হবে।

সুতরাং, জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কার্যকরভাবে করোনা মহামারি মোকাবেলায় আমরা সরকারের কাছে নিন্মোক্ত ১২ দফা পদক্ষেপ অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি:

১. প্রায় ৭ কোটি শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের জনগণের সুরক্ষায় সুষম খাদ্য অথবা দুর্যোগ ভাতা দিয়ে লকডাউন নিশ্চিত করতে হবে।

২. কর্মহীন মানুষের জন্য বেকারভাতা দিতে হবে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত ভাড়াটিয়াদের আবাসন ভাতা দিতে হবে। সরকারি পরিসেবার বিল পরিশোধ স্থগিত করতে হবে।

৩. কৃষকসহ স্বকর্মসংস্থানকারী হকার, ক্ষুদে দোকানদার, কারিগর, রিক্সা-ভ্যান-অটো চালক ইত্যাদি জনগণের কিস্তি ও ব্যাংক ঋণের সুদ আদায় বন্ধ ও মওকুফ করতে হবে।

৫. শ্রমিক ও কর্মচারিদের মজুরি-বেতন, বোনাস পরিশোধ, লে-অফ, ছাঁটাই বন্ধ, ছাটাইকৃতদের নিয়োগ, শতাভাগ সবেতন ছুটি, জরুরী কাজে কর্মরতদের ঝুঁকিভাতা, চিকিৎসা খরচ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, আক্রান্তদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ এবং মৃত্যুতে আজীবন আয়ের দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

৬. প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. ছোট কারখানা মালিক, খামারি ও কারবারিদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে এবং প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

৮. সাংবাদিক, উকিল, শিক্ষক পেশাজীবী, চাকরিজীবীদের মধ্যে যাদের আয় বন্ধ হয়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, তাদের ভাতা প্রদান করতে হবে।

৯. হার্ড ইমিউনিটি পলিসি বাতিল করে পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করে করোনামুক্ত অঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনীতি ও জনজীবন সচল করতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে দেশকে করোনামুক্ত করতে হবে।

১০. করোনা মোকাবেলার উপযোগী করে স্বাস্থ্য অবকাঠামো, জনবল ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। বিদ্যমান স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও জনবলের পূর্ণনিয়োগের জন্য বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত বিনাক্ষতিপূরণে রাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে। জনবলের সুরক্ষাসহ উপজেলা পর্যায়ে করোনাক্রান্তদের পূর্ণস্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে সাধারণ চিকিৎসা সেবা দিতে হবে।

১১. ছাত্রদের বেতন ফি মওকুফ করতে হবে। মেসভাড়া সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাতিল হওয়া পরীক্ষাগুলো অবিলম্বে গ্রহণ ও ফল প্রকাশের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।

১২. উপরোক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনগণের উপর করের বোঝা চাপানো যাবে না। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদশালী হওয়াদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এ অর্থের যোগান দিতে হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *