হেগেল এবং বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা

হেগেল। ছবি: সংগৃহিত

সালটি ১৭৭০, তখনও জার্মানরা রোমানদের অধিভুক্ত, বর্তমান জার্মানির  দক্ষিণ  পশ্চিমের শহর ইস্টুটগার্ট-এ জন্ম নেন স্বাধীনতার দার্শনিক খ্যাত “ জর্জ ভিলহেল্ম ফ্রেডরিশ হেগেল”। যিনি জার্মান ভাববাদের জনক এবং একজন দুর্বেধ্য দার্শনিক হিসেবে আজও সারা বিশ্বে পরিচিত।

গত ২৭ আগষ্ট ছিল তাঁর ২৫০তম জন্মদিন। জার্মানির বেশকিছু প্রভাবশালী  দৈনিকে হেগেলকে নিয়ে শিরোনাম হয়।একটি প্রত্রিকার শিরোনাম ছিল  যে,  ২৫০ বছর  পরেও তিনি বর্তমান, অন্যটিতে ছিল  হেগেল;বিশ্ব চেতনা এবং স্বাধীনতার জনক।

বর্তমানে জার্মানিতে হেগেলকে নিয়ে বিস্তর  গবেষণা  করছেন তাদের মধ্য অন্যতম  শিলার বিশ্ববিদ্যালয়ের  অধ্যাপক কালউস , যিনি এই বছরই হেগেলকে নিয়ে তাঁর লিখিত বই “The Idealism of Freedom “ প্রকাশিত করতে যাচ্ছেন। বইতে তিনি লিখিছেন, হেগেলই প্রথম দার্শনিক যিনি স্বাধীনতা কি তা বুজতে মানুষকে উদ্বেলিত করেছেন। হেগেলই প্রথম দার্শনিক যিনি বলেন “Man is Free”। হেগেলই প্রথম বলেন একটি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের  মূলনীতি হওয়া উচিত সঠিক বিচার ব্যবস্থা এবং শিক্ষা।

তিনি বর্তমান পুঁজিবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং ছিলেন  ঘোর সমালোচকও। তাঁর মতে দারিদ্র একটি আধুনিক সমাজ কাঠামোর প্রধান সমস্যা, এটি কোন বাক্তির একক সমস্যা নয়। হেগেল বলেন, একটি  টেকসই সমাজের জন্য, প্রকৃতি এবং সমাজ এই দুই এর মধ্যে যে ভিন্ন ভিন্ন বাঁধাগুলো রয়েছে সেগুলো  মোকাবেলাই আসল প্রতিবন্ধকতা। উদাহরণস্বরূপঃ সঠিক স্বাস্থ্যনীতি, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষার সঠিক মান প্রত্যেকটি একটি অপরটির সাথে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক।

এছাড়াও জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন হেগেল।পরবর্তীতে  অনেক জার্মান  দার্শনিকরা তাকে বর্জন করা শুরু করেন। এমনকি  অনেকেই তাকে “Dead Dog” বা “মৃত কুকুর” বলে আখ্যায়িত করেন। হেগেল জাতীয়তাবাদের প্রবলভাবে  বিশ্বাসী  জার্মানদের  “বোকা জার্মান” বলে সমালোচনা করেন।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি  চলে যান ছোট শহর টুইবিঙ্গে, সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। মূলত তিনি একজন ধর্মযাজক হতে চেয়েছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় তাকে ব্যাপকভাবে  প্রভাবিত করেন বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক “জাজাক রুশু” এবং তাঁর বই “The Emile on Education”। এই টুইবিঙ্গে দেখা হয় বিখ্যাত জার্মান কবি শিলার-এর সাথে এবং পরবর্তীতে ওনার সাথে দেখা হয় জার্মান জাতীয় কবি গ্যোটের সাথে । কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকতা করেছেন,তবে তাঁর আলোচিত কর্মজীবন ছিল ১৮১৭ থেকে ১৮৩১।

শিক্ষার্থীদের সাথে ক্লাসরুমে হেগেল। ছবি: সংগৃহিত

১৮১৭ সালে তিনি  জার্মানির স্বনামধন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকতা করার পস্তাব পান, এর মধ্যে থেকে  বেছে নেন জার্মানির বিখ্যাত  হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ্য “The Encyclopedia of the Philosophical Sciences”

ফরাসি বিপ্লবের  প্রবল সমর্থক ছিলেন  হেগেল। এমনকি  অনেক ফরাসি দার্শনিকেও প্রভাবিত করেছেন  তাঁর দর্শন দ্বারা।

ইয়েনাতে হেগেল এবং নেপুলিয়ান । ছবি: সংগৃহিত

একবার শীতের শুরুতে জার্মানির ছোট শহর ইয়েনাতে ঘোড়সওয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন  আধুনিক ফরাসিদের পিতা নেপুলিয়ান বোনাপার্ট। শহরের এক গলিতে দেখা হয় হেগেল-এর সাথে। ঘোড়ার  উপরে  নেপুলিয়ানকে দেখেই তিনি একটি বাক্য উচ্চারণ করেন,” World soul on Horsebreak”   নেপুলিয়ান  কথাটি শুনে অভিভূত হন এবং পরবর্তীতে হেগেল  ফরাসি রাজ্যসভায় অতিথি  হিসেবে নিমন্ত্রণ পান ।

তৎকালীন রোমান সম্রাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “philosoply of law”,কিন্তু তৎকালীন পুরসিয়ার রাজা তাঁর গ্রন্থটি প্রকাশে বাঁধা দেন কিন্তু ততো দিনে সেই  গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কপি অনেকের হাতে পৌঁছে যায়, পরবর্তীতে তাঁর গ্রন্থটি   প্রকাশিত হয়। অনেকের ধারনা  সেই বইয়ের একটি বাক্য যা জার্মানদের  পুরসিয়াদের থেকে স্বাধীনতা পেতে  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, বাক্যটি হল  “what is reasonable is real and what is real is reasonable”.

আগেই বলেছিলাম  আজও সারাবিশ্বে  হেগেল একজন দুর্বেধ্য দার্শনিক এমনকি  জার্মানিতেও। গতকাল জার্মানির প্রভাবশালী দৈনিক ফ্রাঙ্কফ্রুট আল্গেমাইন হেগেল কে নিয়ে শিরোনাম করেন  “The difficult One”।

বোঝাই যাচ্ছে উনি কতোটা  দুর্বোধ্য দার্শনিক ছিলেন। হেগেল নিজেও বলেছে, ভাববাদী দর্শন যিনি লেখেন বা যিনি চিন্তা করেন একটা সময় যাওয়ার পড় সে নিজেও বুঝতে পারেন না তাঁর দর্শনের গোড়া কোথায় ছিল?

যত কথাই বলা হোক না কেন, এখনকার সময়ে মানবতা বা  আধুনিক সমাজ রাষ্ট্রের  মূলনীতি, সঠিক স্বাস্থ্যনীতি, টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষার সঠিক মান নিয়ে যে দর্শন তিনি দিয়ে গেছেন  বর্তমান বিশ্বে এই দর্শন সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। একারনেই ২৫০ বছর পড়েও আজোও তাকে  বিশ্ব মনে রেখেছে “philosoar of freedom” হিসেবে। আগ্রহী পাঠকরা চাইলে তাঁর কিছু বই পড়ে দেখতে পারেন।

উল্লেখ্য তাঁর মৃত্যুর  পরে বা আগে তাঁর দর্শন ইউরোপ-এ বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। হেগেল  পরবর্তীতে অনেক ইউরোপীয় দার্শনিকদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেন, যেমনঃ জার্মানির কার্ল মার্ক্স, নিতশে, ইতালির  গ্রামসি, ব্রিটিশ দার্শনিক বাট্রান্ড রাসেল, ফরাসি দার্শনিক মরিস মেরিলিউ-পন্টি।

২৫০তম জন্মদিনে মুক্তির দর্শন দাতা খ্যাত ‘জর্জ ভিলহেল্ম ফ্রেডরিশ হেগেল’-কে স্মরণ করছি‌ শ্রদ্ধাভরে।

লেখক: সদস্য, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও সংবাদকর্মী, জার্মানি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *