বন্ডেড ওয়্যারহাউসের অপব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানির জালিয়াতির মাধ্যমে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের নেতৃত্বে থাকা এই ব্যবসায়ী ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসার অন্তরালে তার মালিকানাধীন নাসা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার করে আসছেন। নজরুল গত চার বছরে অবৈধভাবে কমপক্ষে ২১০ কোটি টাকা যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পাচার করা ওই টাকায় এসব দেশে তিনি তার আত্মীয়স্বজনের নামে বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি কিনেছেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে চার বছরে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাক টু ব্যাক এলসি দেখিয়ে নামে মাত্র আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে এ অর্থ হাতিয়েছেন। ব্যাক টু ব্যাক এলসির সুবিধা নিয়ে পণ্য আমদানি করেছেন কিন্তু রপ্তানি করেছেন এর চেয়ে কম। আমদানিকৃত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে অনেক বেশি মুনাফা করেছেন তিনি, যা পুরোপুরি জালিয়াতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংক থেকে সীমা অতিক্রম করে ঋণ নিয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। নাসা গ্রুপের টেক্সটাইল ইউনিট ও গার্মেন্ট ইউনিটে আলাদা করে ঋণের বিষয়ে অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এতে দেখা গেছে, টেক্সটাইল ইউনিটে ২০১৫ সালে ঋণসীমা ছিল ১৪৫ কোটি টাকা, কিন্তু নেওয়া হয়েছে ৩৫৩ কোটি টাকা। আর আমদানি করা হয়েছে ১৭৪ কোটি টাকার, কিন্তু রপ্তানি করেছে ১৫৩ কোটি টাকার পণ্য। ২০১৬ সালে ২৮ কোটি টাকা সীমা অতিক্রম করে তিনি ঋণ নিয়েছেন ১৭৮ কোটি টাকা। পণ্য আমদানি করেছেন ১৬০ কোটি টাকার, আর রপ্তানি করেছেন ১৮৮ কোটি টাকার পণ্য। ২০১৭ সালে আমদানি করেছেন ২০৪ কোটি টাকার, আর রপ্তানি করেছেন ১৯৩ কোটি টাকার পণ্য। ২০১৮ সালে আমদানি করেছেন ২২৫ কোটি টাকার, আর রপ্তানি করেছেন ১৭৮ কোটি টাকার পণ্য। গার্মেন্ট ইউনিটে ঋণ বিতরণ আমদানি-রপ্তানির তথ্যেও এমন অনিয়ম পাওয়া গেছে। এই ইউনিট ২০১৫ সালে আমদানি করেছে ৬৪৮ কোটি টাকার, আর রপ্তানি করেছে ৫৫৪ কোটি টাকার পণ্য। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে আমদানি করেছে ৭০৬ কোটি টাকার পণ্য, বিপরীতে রপ্তানি করেছে ৬৯৪ কোটি টাকার। ২০১৮ সালে ৪১০ কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করে ৪৬৮ কোটি টাকার ঋণ নেয় প্রতিষ্ঠানটি এর মধ্যে তারা আমদানি করে ৭৭৮ কোটি টাকা পণ্য, আর রপ্তানি করে ৭২৮ কোটি টাকার। বন্ডের সুবিধা নিয়ে পণ্য আমদানি করে এভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নজরুল ইসলাম মজুমদার।
সূত্র জানায়, নাসা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান নাসা অ্যাপারেলস, এ জে সুপার গার্মেন্টস, লিজ অ্যাপারেলস, স্টার লাইট নিটওয়্যার, কিমিয়া অ্যাপারেলস, এমএনসি অ্যাপারেলস, নাসা তাইপে স্পিনার্স, নাসা নিট লিমিটেড, বাবুল চৌধুরী নামক ব্যক্তি, ডেনিম সল্যুশন, নাসা বেসিক লিমিটেড, নাসা তাইপে টেক্সটাইল ইত্যাদি। এসব কোম্পানির মাধ্যমে ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে মাত্রাতিরিক্ত আমদানি ও নামমাত্র রপ্তানি দেখিয়ে এই টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এসব লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গ্রাহক কর্তৃক চেক, পে-অর্ডার বা নগদ অর্থ উত্তোলনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্যান্য ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। এসব অর্থ কোথায় এবং কী উদ্দেশ্যে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়েছে এবং কোন খাতে ব্যবহৃত হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, এ ক্ষেত্রে সজ্ঞানে ও সুস্পষ্টভাবে ঋণের তহবিল ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে চেক বা পে-অর্ডার ভাঙানোর জন্য বাই সালাম পদ্ধতি (প্রি-শিপমেন্ট ফাইন্যান্স প্রোডাক্ট) ব্যবহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির এই ভুয়া বিল উত্তোলনের জন্য বেশির ভাগ সময় এলসি খোলা হয়েছে তার নিয়ন্ত্রণাধীন এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে।
এ ছাড়া আরও অন্তত ১০টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলেছেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গ্রাহক কর্তৃক (নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান) এসব ঋণের আবেদন এবং অনুমোদনের জন্য যেসব নোট উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে প্রকৃত আমদানি-রপ্তানির তথ্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এই ঋণের উদ্দেশ্য যদিও হওয়ার কথা রপ্তানির আগে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান রাখা, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ, বিভিন্ন বিল পরিশোধ প্রভৃতি। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপরীতে লেনদেন করা তথ্যের সঙ্গে উপরোক্ত বাধ্যবাধকতাগুলোর মিল পাওয়া যায়নি। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, গ্রাহক কর্তৃক সজ্ঞানে ও সুস্পষ্টভাবে এসব ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে, যা গুরুতর আর্থিক অনিয়ম বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসব ঋণের বিপরীতে চারটি শর্ত শতভাগ পরিপালনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এর কোনোটিই পরিপালন করেনি নাসা গ্রুপের এসব অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। শর্তগুলো হলো- ১. মূল রপ্তানি চুক্তি বাই ঋণপত্রে লিয়েন রাখতে হবে, ২. মূল রপ্তানি চুক্তি/ঋণপত্রের প্রকৃত ইউটিলাইজেশনের ভিত্তিতে ঋণ প্রদেয় হবে, ৩. ঋণের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে লিয়েনকৃত ঋণপত্র/চুক্তি রপ্তানিমূল্য, প্রত্যাবাসনের মেয়াদ সাধারণত ৯০ দিন (তিন মাস) হবে, ৪. প্রত্যাবাসিত রপ্তানিমূল্য দ্বারা দায় সমন্বয় করতে হবে।
কিন্তু এসব ঋণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কোনো শর্তই মানা হয়নি। ঋণপত্র লিয়েন রাখা হয়নি। রপ্তানি মনিটরিং করা হয়নি। তিন মাসের মেয়াদের ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে এক বছর পর্যন্ত দায় পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, এসব ঋণের মেয়াদের দায় পরিশোধে এমন কৌশল নেওয়া হয়েছে, যেখানে লেনদেনের তারিখ ধরা হয়েছে খেলাপি হয়ে যাওয়ার এক বা দুই দিন আগে, যা এক ধরনের চাটুকারিতা ও অপকৌশল বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।