আবিষ্কারে নতুন উদ্ভাবন : অপচয় ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহণ এইবার

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ গত ১৪ ই অক্টোবর একটি গবেষণাপত্র দ্বারা কিভাবে অপচয় হ্রাস করে বিদ্যুতের ব্যবহার সবার জন্য আরেকটু সহজলভ্য করা যায় তার উপর জোরালো প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। এই আবিষ্কারের পিছনে রয়েছেন নিউ ইয়র্কের রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী রঙ্গা ডায়াস ও তাঁর সহযোগীরা।

ছবি : সংগৃহীত

 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার অপরিহার্য। কিন্তু এর যেমন ব্যবহার হচ্ছে পাশাপাশি হচ্ছে এর অপচয়। অপচয়ই বিদ্যুৎশক্তির পরিবহণে সবচেয়ে বড় সমস্যা। তার ফলে, বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের খরচ বেড়ে যায় এবং পাশাপাশি বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের দাম বাড়ছে।তাই বিভিন্ন দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে এই বিদ্যুৎ পরিবহনের ব্যবহার থেকে।

গত ১১০ বছর ধরে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজার চেষ্টা চলছিল বিশ্বজুড়ে। তারপর অনেক গবেষণার পর খোঁজ মিলল এমন এক যৌগের যাতে রয়েছে – হাইড্রোজেন, কার্বন আর সালফার, এই তিনটি মৌল একসাথে। গবেষকদের মতে, এই পদার্থটি ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও খুব ভাল অতিপরিবাহী।  এই পদার্থের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরিবাহিত হলে বিদ্যুৎশক্তির কোনও অপচয়ই হয় না। কারণ বিদ্যুৎ সেই পদার্থের মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত হওয়াতে কোন প্রকারের বাধাগ্রস্ত হতে হয়না।

ভারতেও এই প্রচেষ্টা চলছে বেশ কিছু দিন ধরে। কিন্তু সমস্যার কোন সমাধানই মিলছিল না। প্রতি বারই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অতি কম তাপমাত্রা, যা গরম আবহাওয়ার দেশগুলিতে বাস্তবিক ভাবে কোনও বিকল্প পথ দেখাতে পারেনি। তাই ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এবং কম অপচয়ে অতিপরিবাহী পদার্থ আবিষ্কারের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু অনেক পরিশ্রম আর সময়ের ফল পাওয়া গেল।

মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)’-এর কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক প্রতাপ রায়চৌধুরীর মতে, ” এই আবিষ্কার সেই লক্ষ্যে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে পদার্থ বিজ্ঞানে “।

তবে সদ্য আবিষ্কৃত অতিপরিবাহী পদার্থটির ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আপাতত একটি সমস্যা রয়েছে। যার সম্পর্কে আরও কথা বলেছেন কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক প্রতাপ রায়চৌধুরী এবং বিজ্ঞানের গবেষণায় লিপ্ত প্রতিষ্ঠান বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)’-র অধ্যাপক অরিন্দম ঘোষ। তাদের মতে, উদ্ভাবিত সমস্যাটি হচ্ছে চাপ সংক্রান্ত। এই পদার্থটির মধ্যে অতিপরিবাহিতা ধর্মের সন্ধান করতে গিয়ে, গবেষকদের কৃত্রিম ভাবে যে পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি । এই চাপ বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপের প্রায় ২৬ লক্ষ গুণ। তবে পৃথিবীর অভ্যন্তরে (‘কোর’) তরল স্রোতের জন্য যে পরিমাণ চাপ সব সময়েই থাকে তা আমাদের বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপের ৩০ লক্ষ গুণ।

অরিন্দম ও প্রতাপ এর সমাধান কল্পে আরও বলেন, “বাইরে থেকে দেওয়া এই চাপের পরিমাণও আগামী দিনে কমানো যেতে পারে। সেটা সম্ভব হতে পারে এমন ধরনের অন্য কোনও যৌগিক পদার্থের আবিষ্কারের মাধ্যমে।”

প্রতাপ জানিয়েছেন , “১৯৩৫ সালে দুই বিজ্ঞানী ভিগনার এবং হাটিংটন এক শতাব্দীর আগেই এ নিয়ে একটি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। যাতে উল্লেখছিল, পর্যায় সারণীর প্রথম মৌল হাইড্রোজেনের মধ্যেও ধাতব ধর্ম দেখা যেতে পারে! তখন তা হয়ে যাবে ‘মেটালিক হাইড্রোজেন’। শূন্যের অনেক নীচের তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন গ্যাস (ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন থাকে গ্যাসীয় অবস্থায়) যখন কঠিন (‘সলিড’) অবস্থায় পৌঁছয় তখন তার ভিতরের অণুগুলির সজ্জা-বিন্যাসের কারণে সেই হাইড্রোজেনের মধ্যে ধাতব ধর্ম দেখতে পাওয়া সম্ভব। উচ্চ চাপে। তবে সেই ধাতব হাইড্রোজেনের মধ্যে অতিপরিবাহিতাও পাওয়া যাবে কি না সে ব্যাপারে তাঁরা কিছু বলতে পারেননি”। কিন্তু তার পর অনেক দিন এ ব্যাপারে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়নি। বলা যায়, তার গোড়াপত্তন হয় আজ থেকে ৫২ বছর আগে।

প্রতাপের বক্তব্য অনুসারে, এরপর ২০০২-’০৩ সালে জাপান ও আমেরিকার তিনটি গবেষকদল জানায় পর্যায় সারণীতে হাইড্রোজেনের ঠিক নীচে থাকা লিথিয়ামের উপর চাপ প্রয়োগ করা হলে তা ১৬ থেক ২০ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী হয়ে ওঠে। এর পর ২০০৪-এ অ্যাশক্রফ্‌টই দেখান ধাতব হাইড্রোজেনের মধ্যে অতিপরিবাহিতার খোঁজ পেতে বিকল্প পথেও হাঁটা যেতে পারে। সেখানে হাইড্রোজেনেরও কোনও যৌগকে ব্যবহার করা যেতে পারে। সেই প্রচেষ্টার প্রথম সফলতা পাওয়া যায় ২০১৫ সালে। শূন্যের ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রা নীতে হাইড্রোজেন সালফাইডের মধ্যে অতিপরিবাহিতা দেখা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে ১৫ লক্ষ গুণ চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছিল বায়ুমণ্ডলের উপর। তার পর গত বছর জার্মানি ও আমেরিকার দু’টি গবেষকদল জানায়, ল্যান্থানাম ডেকাহাইড্রাইডের মধ্যেও এই অতিপরিবাহিতা পাওয়া গিয়েছে। শূন্যের নীচে মাত্র ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, পদার্থটির মধ্যে মিথেন ও ট্রাই-হাইড্রোজেন সালফাইড রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। দু’টি হিরের খণ্ডের মধ্যে কার্বন, সিলিকন ও হাইড্রোজেনকে রেখে বাইরে থেকে চাপ দিয়ে এ বার ওই যৌগের মধ্যে অতিপরিবাহিতার সন্ধান পাওয়া গেল। তা ছিল পুরোপুরি ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায়। এর থেকে সন্ধান মিলল কম অপচয়ে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহারের নতুন যৌগ। যা বিজ্ঞানের বিশ্বে একটি বিরল আবিষ্কার বলে বিবেচনা করা হয়।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *