আম্ফানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, মৃত্যু ২৪

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ডহয়ে গেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল। বিভিন্ন এলাকায় তছনছ হয়েছে বিদ্যুৎলাইন। বিধস্ত হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি, উপড়ে ও ভেঙে পড়েছে গাছপালা। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের ক্ষেত ও মৌসুমি ফলের। ভেসে গেছে কৃষকের মাছের ঘের। অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। ভেঙে গেছে শহর-গ্রামরক্ষা বাঁধ। হুমকির মুখে রয়েছে অনেক এলাকার বেড়িবাঁধ।

ফলে এখনও আতঙ্কে ওই এলাকার মানুষ। গাছের ডাল পড়ে ও ভাঙনে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকায়। উপকূলবর্তী জেলাগুলো এক বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে  উপকূলবর্তী জেলা সাতক্ষীরা। সুপার সাইক্লোনে রূপ নেয়া এ ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নিয়েছে অন্তত: ২৪ জনের প্রাণ। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন- যশোরের ১২ জন, পিরোজপুরের ৩ জন, পটুয়াখালীর ২ জন, ভোলার ২ জন, বরগুনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ১ জন করে। নিহতরা বেশির ভাগই আম্ফানের তাণ্ডবে গাছ চাপা পড়ে মারা গেছেন। বিস্তারিত প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-

যশোর প্রতিনিধি জানান,ঘূর্ণিঝড়ে ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে জেলা প্রশাসক ছয় জন নিহত হওয়ার সংবাদ নিশ্চিত করেছেন। প্রশাসনের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী নিহতরা হলেন—জেলার চৌগাছা উপজেলার পৌর এলাকার হুদো চৌগাছার ওয়াজেদ হোসেনের স্ত্রী চায়না বেগম (৪৫) ও মেয়ে রাবেয়া খাতুন (১৩), বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজহাট ইউনিয়নের বুদোপুর গ্রামের ছাত্তার মোল্লার স্ত্রী ডলি খাতুন (৪৫) এবং শার্শা উপজেলার গোগা ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া গ্রামের শাহাজাহানের স্ত্রী ময়না খাতুন (৪০), বাগআচড়া ইউনিয়নের জামতলা গ্রামের আব্দুল গফুর পলাশের ছেলে মুক্তার আলী (৬৫) এবং শার্শা ইউনিয়নের মালোপাড়া গ্রামের সুশীল বিশ্বাসের ছেলে গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস। চৌগাছার একই ঘটনায় ওয়াজেদ হোসেনের ছেলে আলামিন (২২) আহত হয়েছেন।

এদিকে পুলিশের বিশেষ শাখার রিপোর্ট অনুযায়ী মণিরামপুর উপজেলায় আরো ছয় জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। তারা হলেন—মণিরামপুর উপজেলার পারখাজুরা গ্রামের খোকন দাস (৭০), তার স্ত্রী বিজন দাস (৬০), ওয়াজেদ আলী (৫০), তার ছেলে ইসা (১৫) ও আছিয়া বেগম (৭০)। এছাড়া শার্শা উপজেলার মহিপুড়া গ্রামের মিজানুর রহমান (৬০) নামে আরো একজনের মৃত্যু সংবাদ দিয়েছে পুলিশ। ডিস্ট্রিক্ট ইন্টেলিজেন্স অফিসার (ডিআইও-১) এম মসিউর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের মধ্যে জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলায় দু’জন এবং ইন্দুরকানী উপজেলায় একজনের মৃত্যু হয়েছে।   নিহতরা হলেন- মঠবাড়িয়া উপজেলার দাউদখালী ইউনিয়নের গিলাবাদ গ্রামের মজিদ মোল্লার ছেলে শাহজাহান মোল্লা (৫৫) ও আমড়াগাছিয়া ইউনিয়নের ধুপতি গ্রামের মুজাহার বেপারীর স্ত্রী গোলেনুর বেগম (৭০) এবং ইন্দুরকানী উপজেলার উমিদপুর এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে শাহ আলম (৫০)। মঠবাড়িয়া থানার ওসি মো. মাসুদুজ্জামান জানান, শাহজাহান মোল্লা মঠবাড়িয়া সরকারি কলেজের পেছনে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলেজের পেছনে বাসায় যাওয়ার পথে রাস্তার পাশের একটি বাড়ির সীমানা প্রাচীর ভেঙে পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোজাহার বলেন, আমড়াগাছিয়া ইউনিয়নের ধুপতি গ্রামের গোলেনুর বেগম সন্ধ্যায় নিজের ঘর থেকে পাশের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। বাতাসের ধাক্কায় তিনি পা পিছলে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর ইন্দুরকানী উপজেলার উমিদপুর গ্রামে শাহ্ আলমের বাড়িতে পানি ঢুকতে শুরু করলে ‘আতঙ্কিত হয়ে’ ঘরের ভেতরেই তার মৃত্যু হয় বলে জানান মোজাহার।

পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে পটুয়াখালীতে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের গলাচিপা উপজেলায় রাসেদ (৬) নামে এক শিশু ও কলাপাড়ায় শাহ আলম নামে সিপিপি’র এক কর্মীর রয়েছেন। গলাচিপা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম জানান, সন্ধ্যায় গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে ছয় বছরের শিশু রাসেদ মারা গেছে। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় জনগণকে সচেতন করতে গিয়ে মো. শাহ আলম মীর (৫৫) নামে একজন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নে খেয়া পার হওয়ার সময় পানিতে পড়ে তিনি নিখোঁজ হন। পরে সন্ধ্যায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, উপকূলবর্তী জেলা সাতক্ষীরায় প্রবল আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। বুধবার রাত ৮টার পর দ্বিতীয়বার ১৪৮ কিলোমিটার গতিতে আবারও আঘাত হানে এ জেলায়। সঙ্গে প্রবল বর্ষণে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ৯টি গ্রাম। এছাড়া ১৩টি বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এদিকে এর মাত্রা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী। তিনি জানান, রাত ৮টার পর আঘাত হানে আম্ফান। রাত ১০টা পর্যন্ত ঝড়ের গতি একই ছিল। ঝড়ের আঘাতে সাতক্ষীরা সদর থানার কামালনগরে এক নারীর মৃত্যু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ির। ভেঙেছে গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি।

ভোলা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে চরফ্যাশন উপজেলায় সিদ্দিক ফকির (৭০) নামে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। এছাড়া এক নারী গুরুতর জখম হয়েছেন। বুধবার সকাল ৯টার দিকে উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার চর কচ্ছুপিয়া এলাকার রেইনট্রি গাছ ভেঙে মাথায় পড়ে সিদ্দিক ফকির জখম হয়। তাকে তাৎক্ষণিক চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল হাসপাতালে প্রেরণ করেন। পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়। এদিকে আম্ফানের তাণ্ডবে পড়ে রামদাসপুর চ্যানেল ৩০ যাত্রীসহ একটি ট্রলার ডুবে একজন নিহত হয়েছে। ট্রলার ডুবিতে নিহত ব্যক্তির নাম রফিকুল ইসলাম। তার বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মনিরাম এলাকায়।

বরগুনা প্রতিনিধি জানান, বরগুনার সদর উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্র  যাওয়ার পথে এক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী ‘অসুস্থ হয়ে’ মারা গেছেন। শহীদুল ইসলাম নামের ওই ব্যক্তির বয়স ৬৪ বছর। তিনি উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন। পরীরখাল বাজারে রেস্তোরাঁ চালাতেন তিনি। বরগুনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা আক্তার জানান, শহীদুল আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ সেলিম জানান, এ ইউনিয়নের পরীরখাল মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে শহীদুল ইসলামের মৃত্যু হয়। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহে বুধবার রাতে ঝড়ের মধ্যে ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রাত ১০টার পর ঝড়ের দাপট বাড়লে সদর উপজেলায় হলিধানী গ্রামে একটি গাছ ভেঙে ঘরের ওপর পড়ে নাদিরা বেগম নামে ৫৫ বছর বয়সী ওই নারীর মৃত্যু হয়।

চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরে গাছ চাপা পড়ে জান্নাত বেগম (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত জান্নাত বেগম চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের রাঢ়ীর পুল এলাকার গাজী বাড়ির ওহাব গাজীর মেয়ে। বুধবার রাত ২ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, ঝড় চলাকালে রাত ২টার দিকে জান্নাত বেগম আম খুঁজতে গেলে গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

এছাড়া বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সন্দ্বীপ পৌরসভা ২নং ওয়ার্ডে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের জোয়ারে ভেসে যাওয়া এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। নিহত যুবকের নাম মো. সালাউদ্দিন (১৮)। তিনি পৌরসভা ২ নম্বর ওয়ার্ডের হোনাজীর বাড়ির আবুল কাশেমের ছেলে। জানা গেছে, চরে গবাদিপশুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় সালাউদ্দিন।

Spread the love

২ thoughts on “আম্ফানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, মৃত্যু ২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *