আলোর গতি মাপা হলো কীভাবে?

আমরা সকাল বেলা উঠেই দেখতে পাই চারদিক ঝক ঝক করছে । যদি এমন হতো আলো এসে পৌঁছাচ্ছে না, তাহলে কিছুই দেখতে পেতাম না। সব অন্ধকার হয়ে থাকত। আবার এমন যদি হয় হঠাৎ সূর্য আলো দেয়া বন্ধ করে দিলো। মানে লাইটের মতো কেউ সুইচ অফ করে দিলো তাহলে সেটা বুঝতে পৃথিবীর মানুষের সময় লাগবে ৮ মিনিট। আমরা লাইট অফ করলে সেটা সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু সূর্য আলো দেয়া বন্ধ  করলে সেইটা বন্ধ হতে ৮ মিনিট সময় লাগবে কেন? সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে প্রায় ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ডের মতো সময় লাগে। আলোর গতি অনেক, কিন্তু অসীম না। আলোর সেই গতি প্রথমবার কীভাবে বের করা হয়েছিল? কে করেছিল?

আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিকতার বিশেষ সূত্রগুলি আলোর ওপর (বিশেষ করে আলোর গতিবেগের ওপর) ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। তবে আলো কী বা কী দিয়ে তৈরি, এর আচরণ কেমন, এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আজও অনেকটা হিমসিম খান। একেক রকম পরীক্ষায় আলোর আচরণও একেক রকম বলে মনে হয়। ফলে, বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা আলো সম্পর্কে বিভিন্ন রকম কথা বলে থাকেন।

বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন, ‘আলো’ হচ্ছে ছোট ছোট অসংখ্য কণিকা দিয়ে গঠিত এবং ওই কণিকাগুলির কোনো ওজন নেই। এই কণিকার নাম হলো ‘ফোটন’ (Photon)। যে কোনো উৎস থেকেই এই কণিকা অর্থাৎ ফোটনগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে বের হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

পদার্থবিজ্ঞানী হাইগেন্স বলেন, ‘আলো’ চলে তরঙ্গের মতো করে।

এদিকে, আবার ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক বলে বসলেন আরেক কথা। তার মতানুসারে, ‘আলো’ চলে গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে বা প্যাকেট প্যাকেট আকারে (একে আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলে)।

আমরা জানি, আলো সোজা পথে চলে। অর্থাৎ উৎস থেকে যেদিক দিয়ে বের হয়, ঠিক সেদিক দিয়ে সোজা চলতে থাকে। এঁকে বেঁকে অন্য কোনো দিক দিয়ে চলে যায় না। তবে শক্তিশালী কোনো চৌম্বক ক্ষেত্রের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় আলো সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকে কিছুটা বেঁকে যায়।

আলোর নির্দিষ্ট গতিবেগ আছে এবং তা হলো শূন্যস্থানে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার অর্থাৎ কোনো উৎস থেকে বের হয়ে এটি প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার করে দূরে চলে যাবে।

আলো সব সময় শূন্যস্থানে দ্রুত বেগে চলে।  মাধ্যম যত বেশি ঘন হবে, সেখানে আলোর বেগও তত কম হবে। যেমন: শূন্যস্থানে আলো যে বেগে চলে, পানির মধ্য দিয়ে তার চার ভাগের তিনভাগ বেগে চলে। অর্থাৎ পানিতে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩/৪*৩০০০০০=২২৫০০০ কিলোমিটার বা দুই লাখ ২৫ হাজার কিলোমিটার। আর কাচের মধ্যে আলোর বেগ শূন্যস্থানের তিন ভাগের দুইভাগ বেগে চলে মাত্র।

আলোর গতি যেভাবে মাপা হলো:

১৬৭৫ সালে কোপেন হেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওলফ রোমার প্যারিসে কাজ করার সময় বৃহস্পতি গ্রহের একটি উপগ্রহের গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করে সর্বপ্রথম আলোর বেগ নির্ণয় করেন। আর একেই বলা হয়, রোমারের জ্যোতির্বিদীয় পদ্ধতি।

তবে তিনি এই কাজটি করার জন্য অর্থাৎ বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহটি পর্যবেক্ষণের জন্য যে টেলিস্কোপটি ব্যবহার করেন, তা গ্যালিলিওরই আবিষ্কার আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তিনি যে উপগ্রহটি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই কাজটি করেন, সেটিও গ্যালিলিওই আবিষ্কার করেন (উপগ্রহটির নাম ‘আয়ো’)।

গ্যালিলিও ১৬১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি একটি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে সেটা দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহ দেখতে থাকলেন। দেখতে দেখতে সেই সময়-ই তিনি বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। উপগ্রহ চারটির নাম ‘আয়ো’, ‘ইউরোপা’, ‘গ্যানিমিড’ ও ‘ক্যালিস্টো’ এবং বর্তমান হিসাব পর্যন্ত এগুলোই বৃহস্পতির সবচেয়ে বড় উপগ্রহ।

ধরা যাক, আমাদের কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে একটি টেবিলের ওপর একটি বল রাখা আছে। আমরা একটি শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে তা দেখছি। বলটি হঠাৎ টেবিল থেকে নিচে পড়ে গেল। বলটি ঠিক যে মূহূর্তে পড়ল, ঠিক সেই মূহূর্তেই কিন্তু আমরা বলটির পড়ে যাওয়া দেখতে পাব না। কারণ, বলটির পড়ে যাওয়ার সময় বল থেকে যে আলো আমাদের দিকে আসবে, সেটি ওই অনেক দূরের পথ অতিক্রম করে আসতে সময় নেবে। অর্থাৎ পড়ে যাওয়ার মুহূর্তের আলোটি সেই পথ পার হয়ে এসে আমাদের চোখে যখন পৌঁছাবে, ঠিক তখনই আমরা বলটি পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে পাব।

এবার রোমার যে কাজটি করলেন, তা হলো- পৃথিবী ও বৃহস্পতির ন্যূনতম ও বৃহত্তম, এই দুই অবস্থানে বা দূরত্বে থাকার সময় ‘আয়োর’ যে গ্রহণগুলো সংঘটিত হয়, তাদের সময়ের হিসাব করে অতিরিক্ত সময়টি বের করেন।

আর এই সময়ে অতিরিক্ত যে দূরত্বটি বৃদ্ধি পেল, অর্থাৎ ‘ক’ থেকে ‘খ’ এর দূরত্বটি তো আগে থেকেই জানা ছিল (কারণ ওটা হলো পৃথিবীর ব্যাস)। সেই অতিরিক্ত সময় দিয়ে অতিরিক্ত দূরত্বকে ভাগ করলে একক সময়ে অর্থাৎ এক সেকেন্ডে আলো কতখানি দূরে যাচ্ছে, সেটি বের করেন। আর এটাই হলো আলোর বেগ।

তার হিসাব অনুযায়ী, অতিরিক্ত দূরত্বটি হলো: ২৯,৯০,০০,০০০ আর অতিরিক্ত ১০০০ সেকেন্ড, যা ভাগ করলে দাঁড়ায় ২,৯৯,০০০ কিলোমিটার বা ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ডে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *