”এবং সিনেমা”

আমাদের ছেলেবেলায় সিনেমা ছিল বিনোদনের অন্যতম প্রধান উৎস। সত্তরের দশকের শেষের দিকে আমার প্রথম সিনেমা দেখা বাবা-মা-দাদার সাথে নাটোরের ছায়াবাণী হলে। তখন আমি খুবই ছোট ছিলাম এজন্য সিনেমার নাম খেয়াল নাই। তবে সিনেমাটা আংশিক রঙীন আর কোনো এক যাদুকরের কাহিনী ছিল তা মনে আছে। সিনেমা শুরুর মুহূর্তে হলঘর অন্ধকার হয়ে গেল, সে এক ভয়ার্ত পরিবেশে সিনেমা দেখা শেষ করেছিলাম। হল থেকে বেড় হয়ে ঠান্ডার এক পরশ পেয়েছিলাম।

আশির দশকে আমি তখন কিছুটা বড়। তখন পত্রিকা পড়তাম। দেখেছি, পত্রিকার পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন থাকতো, কারো কারো ঘরের দেয়ালে সিনেমার পোস্টার লাগানো থাকতো, এমনকি রিকশার পিছনে পেইন্টিং করা হতো সিনেমার কোনো বিজ্ঞাপন। শহর কিংবা গ্রামে ঘোড়ার গাড়ি বা রিকশায় মাইকে সিনেমার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো। দূর থেকে ভেসে আসতো, তখন কান খাড়া করে শুনতাম, হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে… ছায়াবাণী কিংবা হীরামন কিংবা গ্যারিসন সিনেমার রূপালী পর্দায় ‘বাঁচবোনা তোমাকে ছাড়া’। আর ইকো হতো সিনেমার নাম, বাঁচবোনা তোমাকে ছাড়া, তোমাকে ছাড়া… তোমাকে ছাড়া….তোমাকে ছাড়া। ওটা শোনার সে কি আকর্ষণ! ঘোষকের ঘোষণায় এবং কল্পনায় প্রায় অর্ধেক সিনেমা দেখা হয়ে যেতো। তখন প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন সিনেমা হলে প্রদর্শিত হতো। ছলে বলে কৌশলে বাবার কাছে থেকে টাকা নিয়ে প্রায়ই সিনেমা দেখতে চলে যেতাম দুই ভাই। সিনেমা দেখার পরেই আগামি সপ্তাহে কোন নতুন সিনেমা আসছে তার জন্য অপেক্ষা করতাম। আর তখন খুব সহজ ছিল রেডিওতে এ বিষয়টা জানা আগামিতে কোন সিনেমার শুভমুক্তি হচ্ছে। রেডিওতে সেই ভরাট কণ্ঠের ঘোষণা, হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে….। এই কণ্ঠ দিয়েই তখন তারকা ছিলেন ওই সময়ের নতুন নতুন সিনেমার ঘোষক নাজমুল হুসাইন এবং মাজহারুল ইসলাম।

আগে সপরিবারে সিনেমা দেখাটা একটা উৎসব ছিল। তখন দেশে বিদ্যুৎ এর ভীষণ খারাপ অবস্থা ছিল। বিদ্যুৎ এর কারণে সিনেমা শুরু হতো দেরিতে বা অর্ধেক সিনেমা দেখে ফিরে আসার নজীরও নেহাত কম ছিল না। আর এ কারণেই তখন কিছু কিছু সিনেমা হলে ডায়নামা বা জেনারেটর দিয়ে দেখানো শুরু হলো সিনেমা। ফলে সিনেমার দর্শকও বেড়ে যেতো ওইসব হল গুলোতে কারণ আর যাই হোক সিনেমা দেখার টিকিট এর পয়সা পুরোটাই কাজে লাগবে। একটা বিষয় লক্ষ্য করা গেছে তখন সবে ভিসিআর এ সিনেমা দেখা যেতো। প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে বিদ্যুৎ নাই সেখানেও ভিসিআর ও ব্যাটারি ভাড়া করে সিনেমা দেখা হতো। কিন্তু এজন্য সিনেমা হলের দর্শক তখন কিন্তু কমেনি মোটেও।

আমি এমনও দেখেছি আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে যারা সারারাত রেডিওতে নিশুতি অনুষ্ঠান শুনতো। নিশুতি অনুষ্ঠানের বড় আকর্ষণ ছিল পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার পাশাপাশি বিজ্ঞাপন প্রচার। বন্ধুরা নিশুতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সিনেমার ডায়ালগ শুনেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতো। আমি কোনো কোনো বন্ধুকে রেডিওতে সিনেমা শুনে কাঁদতেও দেখেছি।

বেশ ক’বছর আগে আমার পরিচিত একজন বড় ভাই এর সাথে ছোটবেলায় তার দেখা সিনেমার গল্প শুনছিলাম। তিনি জানালেন, সারাজীবনে তিনি হলে গিয়ে অনেক সিনেমা দেখেছেন। বাড়ী থেকে হাঁস চুরি করে হাটে বিক্রি করে তার বন্ধুর সাথে গ্রাম থেকে শহরে সিনেমা দেখতে গিয়েছেন বাসায় কাউকে না বলে। যে টাকায় হাঁস বিক্রি করেছিলেন তা দিয়ে দুই বন্ধু শহরে পৌঁছাতে ও পথিমধ্যে কিছু খেয়ে অবশিষ্ট ছিল মাত্র অল্প টাকা। কিন্তু সে টাকায় দুই জনের টিকিট কাটা সম্ভব না হওয়ায় মারামারি করে ব্ল্যাকে একটি টিকেট কেটে একজন অর্ধেক সিনেমা দেখেছে বিরতি পর্যন্ত আর অর্ধেক সিনেমা নিজে দেখে পরে দু’জনে পুরো সিনেমার গল্প করে স্বাদ মিটিয়েছিল পুরো সিনেমা দেখার। তবে বিরতির পরে অন্যজন হলে ঢুকতে গিয়ে বিপত্তি বাধালো হলের গেইটম্যান। সে আর একজনকে হলে ঢুকতে দিবে না। গেইটম্যান খুব সহজেই অন্য বন্ধুকে চিনতে পেরেছিল এজন্য যে তার শরীর ভেজা ছিল না। তখন ছিল গরমকাল, স্বাভাবিক ভাবেই যারা হলে প্রবেশ করতো তাদের শরীর ঘামে ভেজা থাকতো। অবশেষে তাদের কাছে থাকা মাত্র দুই টাকা ওই গেইটম্যানকে ঘুষ দিয়ে হলে প্রবেশ করেছিলেন। সমস্যা হলো তাদের কাছে বাসায় ফেরার আর কোনো টাকাই ছিল না। তখন ১২টা, ৩টা, ৬টা, ৯টা এই ছিল সিনেমার শো। আর শুক্রবারে চলতো মর্নিং শো। যখন তারা সিনেমা দেখা শেষ করেছিল তখন বাজে রাত ৯ টা। তখন বাসায় ফেরাটা ছিল কষ্টসাধ্য বিষয়। তাই তারা শহরে নিকট আত্মীয়ের বাসায় রাত যাপন করেছিল। সেখানে গিয়ে দেখে তার বড় ভাইও সে বাসায় গিয়েছে সিনেমা দেখে। অবশেষে ধরা পরে গিয়েছিল তাদের গোপন মিশনের বিষয়টা। তবুও রক্ষা বাসায় ফিরতে পেরেছিল তার মাধ্যমে। বাসায় ফিরে ক’দিন লুকিয়ে লুকিয়ে থেকেও ধরা পরেছিল হাঁস চুরি করার বিষয়টা। সে কি লজ্জা! কিন্তু সে লজ্জা বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি তাদের কাছে, কারণ মাঝে মধ্যেই তাদের বাড়ী থেকে মুরগি, ছাগলের বাচ্চা, আলু, ধান বা চাউল চুরি যাচ্ছিল।

ময়মনসিংহ বোমা ট্র্যাজেডি আমাকে সিনেমা হল বিমুখ করেছে। সেই থেকে আজ অবধি আমি কোনো সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখিনি। ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শহরের ছায়াবাণী, অজন্তা, পূরবী ও অলকা- এই চারটি সিনেমা হলে জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি’র সদস্যরা সিরিজ বোমা হামলা চালায়। এটা ছিল পশ্চাৎপদ চিন্তা থেকে সংস্কৃতির উপরে আঘাত। হামলায় শিশু ও মহিলাসহ ১৮ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক দর্শক, যাদের বেশির ভাগই এখন পঙ্গু এবং অসহায়। তবে ইদানিং দেশের অধিকাংশ সিনেমা হলগুলো বন্ধ কোভিড ১৯ এর কারণে। তা না হয় মানলাম স্বাস্থ্যগত কারণে। কিন্তু কোভিড এর বেশ আগে থেকেই সিনেমা হলগুলো বন্ধ কেন তার কি কোনো কারণ আমরা অনুসন্ধান করেছি? আমি বা আমরা চাই সংস্কৃতির বিকাশ। আমরা চাই সপরিবারে দেখার মতো বিনোদন নির্ভর সিনেমা আবার তৈরি হোক। অন্তত যে সিনেমায় বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষামূলক কিছু থাকবে। থাকবে স্মৃতিচারণ, ইতিহাস, সংস্কৃতির বিকাশ। আমি আবার হলে সিনেমা দেখতে যেতে চাই।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *