করোনায় বিপাকে ব্রোকারহাউজের কর্মীরা

করোনাভাইরাসের প্রকোপে জীবন দুঃসহ হয়ে উঠেছে বেশিরভাগ ব্রোকারহাউজের কর্মীদের। অনেক ব্রোকারহাউজেই এখন পর্যন্ত এপ্রিল মাসের বেতন হয়নি। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান কেটে নিয়েছে বিভিন্ন ভাতা। এর মধ্যেই আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা আছেন ছাঁটাই আতঙ্কে। ইদের পর বাজার খোলার কিছু দিনের মধ্যেই অনেক ব্রোকারহাউজে কর্মী ছাঁটাই শুরু হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের আশংকা। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এই আশংকা করছেন।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ও ডিএসই ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) চলমান নাজুক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারের জন্য কিছু প্রণোদনা, বিশেষ করে ব্রোকারহাউজের কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে সরকারের কাছে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার আবেদন করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, দেশের পুঁজিবাজারের জন্য করোনাভাইরাস মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে নেমে এসেছে। গত এক দশক ধরে বাজারে  প্রায় টানা দর পতন চলছে। লেনদেনও নেমে এসেছে তলানীতে। ফলে বিনিয়োগের পাশাপাশি কমিশন আয় কমে যাওয়ায় এমনিতে সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছিল ব্রোকারহাউজগুলো। এরমধ্যেই বড় আঘাত হিসেবে এসেছে  নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)।

ছবি: সংগৃহীত

করোনার প্রকোপের মধ্যেও সারাবিশ্বে খোলা পুঁজিবাজার। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় গত ২৬ মার্চ থেকে চলমান সাধারণ ছুটিতে বন্ধ আছে দেশের পুঁজিবাজারও। লেনদেন না থাকায় ব্রোকারহাউজগুলোতে নেই কোনো আয়। তাতে দীর্ঘ মন্দা সময় পার করা এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংকট চরমে উঠেছে। আর এ কারণে এখন পর্যন্ত অনেক ব্রোকারহাউজেই কর্মীদের এপ্রিল মাসের বেতন হয়নি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) কতভাগ সদস্য প্রতিষ্ঠান কর্মীদের এপ্রিল মাসের বেতন দিয়েছে, আর কতভাগের বাকী আছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন ব্রোকারহাউজের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটি একটা চিত্র পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, ডিএসইতে আনুমানিক ৫০ ভাগ ব্রোকারহাউজে এখনো এপ্রিল মাসের বেতন হয়নি। অন্যদিকে সিএসইতে এই সংখ্যা প্রায় ৮০ ভাগ।

তবে দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই  ব্যাংক, এনবিএফআই ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিভিত্তিক সব ব্রোকারহাউজ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই কর্মীদের বেতন পরিশোধ করে দিয়েছে। বড় গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকানাধীন বেশিরভাগ ব্রোকারহাউজের কর্মীরাও এপ্রিলের বেতন পেয়ে গেছেন। তবে কয়েকটি গ্রুপের মালিকানাধীন ব্রোকারহাউজের কর্মীদের বেতন এখনো বাকি আছে।

কর্মীদের এপ্রিল মাসের বেতন না দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সবই ব্যক্তি মালিকানার ব্রোকারহাউজ। যদিও বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্রোকারহাউজ সময়মতোই এপ্রিলের বেতন পরিশোধ করেছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে ঈদ বোনাস হয়নি এবার। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বোনাস দিয়েছে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বোনাস দিলেও তা প্রাপ্য অংকের চেয়ে অনেক কম। গত কয়েক বছর ধরে দেশের শীর্ষস্থানে থাকা ব্রোকারহাউজটি দিয়েছে প্রাপ্য বোনাসের এক চতুর্থাংশ।

সময়মতো বেতন না হওয়ায় চরম সংকটে পড়েছেন বিভিন্ন ব্রোকারহাউজের কর্মীরা। কারণ ব্রোকারহাউজের কর্মীদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত। এদের বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। তাদের মধ্যে এমবিএ, বিবিএ ডিগ্রিধারীও আছেন। এতদিন এরা সমাজে নিজেদের একটা অবস্থান ধরে রেখে জীবনযাপন। ওই মর্যাদার কথা ভেবে বর্তমান সংকটে তারা কারো কাছে হাতও পাততে পারছেন না।

তবে ব্রোকারহাউজের কর্মীদের মধ্যে বেতনের চেয়েও বেশি মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে চাকরি হারানোর ঝুঁকি। এই কর্মীদের অনেকেই ঘর পোড়া গরু। গত কয়েক বছরে অনেকেই আগের প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন অথবা সহকর্মী-বন্ধুদের চাকরি হারাতে দেখেছেন। বাজারে চলমান টানা মন্দায় ব্যাংক, এনবিএফআই এবং ইন্স্যুরেন্সের মালিকানাধীন ব্রোকারহাউজেও ছাঁটাই হয়েছে। আর ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠানে তো কথাই নেই।

গত বছরের শেষ ভাগে দেশের একটি শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানাধীন ব্রোকারহাউজে একসঙ্গে প্রায় ৭০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়। বছরের শুরুর দিকে অন্য একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ব্রোকারহাউজে ছাঁটাই করা হয় ৪৫ জন কর্মীকে। এর আগেপরে আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই হয়েছে।

করোনায় লেনদেন বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো আরও চাপে পড়েছে। ইদের পরে বাজার খুলে দিলেও লেনদেনে স্বাভাবিক গতি আসতে লাগতে পারে দীর্ঘ সময়। আর বিনিয়োগের লোকসান কাটিয়ে মুনাফায় ফিরতে সময় লাগতে পারে তারচেয়েও বেশি। ততদিন প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে বর্তমান কর্মীদের বেতন-ভাতা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। সে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে কর্মী ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে ব্যয় কমানোর পথে যেতে পারে। অনেক ব্রোকারহাউজ কিছু শাখা গুটিয়ে নেওয়ারও পরিকল্পনা শুরু করেছে। সেটি হলেও কিছু কর্মী চাকরি হারাবেন। সব মিলিয়ে চাকরির  দুঃশ্চিন্তায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ঘুম বন্ধ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন-উর-রশিদ বলেন, বাজার মন্দা থাকায় এমনতিতে ব্রোকারহাউজসহ সংশ্লিষ্ট অনেক প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট সংকটে ছিল। এর মধ্যে লেনদেন বন্ধ থাকায় তাদের ওই সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন দিতে পারছে না। এই বাস্তবতার আলোকেই আমরা সরকারের কাছে একটা প্রণোদনা প্যাকেজ চেয়েছি। আমাদের অনুরোধ, সরকার যেন দ্রুত সহৃদয়ভাবে এই প্রস্তাবনা বিবেচনা করে কিছু ব্যবস্থা নেন।

ডিবিএর সভাপতি শরীফ আনোয়ার হোসেন বলেন, বাজার বন্ধ থাকার কারণে এমন নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে সবাই। তিনি ব্রোকারহাউজগুলোর পরিচালন ব্যয় নির্বাহের সুবিধার্থে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার যে আবেদন করেছেন, সেটি দ্রুত বিবেচনা করতে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

অর্থসূচক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *