কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণ দিবস

ছবি: সংগৃহিত

শব্দের খেলায় মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে যিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। নন্দিত কথাসাহিত্যিক, তুমুল জনপ্রিয় নাট্যকার, সফল চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ এর আজ অষ্টম প্রয়ান দিবস। ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই মরণব্যাধি ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে অসংখ্য ভক্তদের কাঁদিয়ে তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ফয়েজুর রহমান, মা আয়েশা ফয়েজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তাঁর লেখালেখির শুরু। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার। বই দুটি প্রকাশের পর শক্তিশালী লেখক হিসেবে পাঠকমহলে সমাদৃত হন তিনি।

হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশক লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখায় বাঙালি সমাজ ও জীবনধারার গল্প ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন গল্প বলার এক নিজস্ব ভাষাভঙ্গি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন, নির্মাণ করেছেন নাটক ও চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা করেছেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ছিলেন। পরে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য হুমায়ূন আহমেদ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদকসহ অনেক পুরস্কার লাভ করেন।

হুমায়ুন আহমেদকে বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক বলা হত তার জীবদ্দশায়। লেখালেখি করে তিনি পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। তার নতুন বই মানেই নিমিষেই হাজারো কপি বিক্রি হওয়া। এদেশের পাঠকরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন তার নতুন বইয়ের জন্য।

‘মৃত মানুষের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সব অপেক্ষা জীবিত মানুষের জন্য।’ অপেক্ষা উপন্যাসে, মৃত্যু নিয়ে এমন ভাবনাই তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদ। অথচ তাঁর চলে যাওয়ার ৮ বছর পরও লক্ষ কোটি পাঠক-ভক্তরা অপেক্ষায় থাকে তাঁর লেখা নতুন কোন বইয়ের জন্য, সম্ভব নয় জেনেও।

আবার নাট্যকার হিসেবেও তিনি ছিলেন অন্যতম সফল। হঠাৎ করে এলেন সিনেমা নির্মাণে। সেখানেও সফল। সবাই বলত, তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলতো।

শহুরে জীবনে থেকেও বৃষ্টির প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা। বৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা থেকেই হূমায়ুন আহমেদ নিজের একটি বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘বৃষ্টিবিলাস’। ওই বাড়িটি এখনো আছে নুহাশপল্লীতে। বৃষ্টিবিলাস নামে তার একটি উপন্যাসও আছে। জোছনার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে তিনি লিখেছেন অনেক বই। জোছনা রাত উপভোগ করার জন্য নুহাশপল্লীতে কাছের মানুষদের নিয়ে সময় কাটাতেন। সবুজ ঘাসের ওপর হেঁটে হেঁটে জোছনা দেখতেন আর মুগ্ধ হয়ে ভাবতে থাকতেন। জল জোছনা নামে রয়েছে তার একটি উপন্যাস। মৃত্যুর আগে চন্দ্রসখা নামে একটি উপন্যাসও লিখতে চেয়েছিলেন। অন্বেষা প্রকাশন থেকে বইটির প্রচ্ছদও ছাপা হয়েছিল, কিন্ত বইটি লিখে যেতে পারেননি তিনি।

আর ছিল তার সমুদ্রের প্রতি ভালোবাসা ও টান। সমুদ্র বিলাস নামেও তার একটি উপন্যাস আছে। আবার সমুদ্রের প্রতি তীব্র টান থাকার কারণে সেন্টমার্টিনে একটি বাড়িও করেছিলেন। সেই বাড়ি আজও আছে। বৃক্ষের প্রতি কতটা মমতা ছিল তার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নুহাশপল্লীর শত শত দেশি-বিদেশি বৃক্ষই তার প্রমাণ। হুমায়ূন আহমেদ যেখানেই যেতেন নতুন নতুন গাছের চারা নিয়ে আসতেন এবং সেসব রোপন করতেন নুহাশপল্লীতে।

হুমায়ূন আহমেদ সব সময় মনে করতেন জগত রহস্যময়। যার ফলে জগতে রহস্যময় অনেককিছু ঘটে। অনেক বইয়ে এই কথাটি আছে যে জগত রহস্যময়। ভৌতিক ব্যাপার নিয়ে তিনি মজা করতে পছন্দ করতেন।নুহাশপল্লীতে নতুন অতিথি গেলেই মজা করে ভয় ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘এখানে ভূত আছে!’ ভূত বিলাস নামে একটি ঘরও আছে নুহাশপল্লীতে। সুন্দর ডিজাইনের ঘরটিতে রাতের বেলা বারান্দায় বসে সময় কাটাতেন নন্দিত এই লেখক।

হুমায়ূন আহমেদ ছবি তুলতে পছন্দ করতেন। সময় পেলেই তিনি এই কাজটি করতেন আনন্দ নিয়ে। বিশেষ করে দুই পুত্র নিষাদ ও নিনিদের ছবি এবং প্রকৃতির ছবি তুলতে ভালোবাসতেন। ছবি আঁকতেও ভালোবাসতেন হুমায়ূন আহমেদ। দখিন হাওয়ায় তার একটি ছোট্ট ঘর ছিল। ওই ঘরে বসে আঁকাআঁকির কাজটি করতেন। ছবি আঁকার জন্য রং তুলি সব সময় রাখতেন নিজের সঙ্গেই। লেখালেখির মাঝে কখনো কখনো সময় ঠিকই বের করতেন ছবি আঁকার জন্য।

লেখকদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল- তিনি কখনো চেয়ার-টেবিলে বসে লিখতেন না। প্রযুক্তির যুগে ল্যাপটপ বা কম্পিউটারেও লিখতেন না। তিনি লিখতেন মেঝেতে বসে। সারাজীবন ধরে মেঝেতে বসেই লেখালেখির কাজটি করে গেছেন। রাত জেগেও তিনি লিখতেন না। তার লেখার সময় ছিল সকাল থেকে দুপুর। দলবল নিয়ে বেড়াতে পছন্দ করতেন এই মানুষটি। সেটা কি দেশ, কি বিদেশ। তার সফরসঙ্গি হয়েছিলেন আরেক খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলন।

তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন ভাইয়ের ছিল বিশাল একটা মন। তিনি খরচ করতেন দুই হাতে। সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন।’ যেখানেই যান আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন হুমায়ূন আহমেদ। তার দখিন হাওয়ায় নিয়মিত আড্ডার কথা অনেকেরই জানা। এমন এক আড্ডা থেকেই পরিচয় হয়েছিল প্রয়াত অভিনেতা এএসএম তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। সেই আড্ডাতেই হুমায়ূন আহমেদ তার নাম দেন চ্যালেঞ্জার।

শুধু কী জীবদ্দশায় এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পাঠকপ্রিয় লেখক ছিলেন তিনি? তার মৃত্যুর পরও পাঠকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েই আছেন তিনি। এখনো একুশে বই মেলায় তার বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। অবাক করা তথ্য- এদেশে লেখালেখির জন্য হুমায়ূন আহমেদই সবচেয়ে বেশি সম্মানী নিতেন। আট বছর হলো তিনি নেই। কিন্ত তার অসংখ্য বই, টিভি নাটক, সিনেমা, গান রয়ে গেছে।

নন্দিত নরকে উপন্যাস দিয়ে লেখক জীবনের সূচনা করেছিলেন তিনি। দেয়াল নামের রাজনৈতিক উপন্যাস দিয়ে লেখালেখির ইতি টানেন। তারপর পরাজিত হন ক্যান্সার নামক মরণব্যাধির কাছে। কিন্তু পাঠকের কাছে তিনি কোনোদিনও পরাজিত হননি। বাংলা ভাষার পাঠকরা তাকে পরম মমতায় ভালোবেসে চলেছেন ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আজও তিনি সবার কাছে নন্দিত হুমায়ূন আহমেদ। প্রতি বছরের মতো না হলেও, সীমিত আকারে পরিবার ও ভক্তরা দিনটিতে স্মরণ করবে নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে, দেশজুড়ে।

জানা গেছে, করোনাকালের কারণে এবার সীমিত আকারে দোয়ার আয়োজন থাকছে হুমায়ূন আহমেদের জন্মস্থান নেত্রকোনা এবং লেখকের সবচেয়ে প্রিয় স্থান গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে। টিভি চ্যানেলগুলোতেও থাকছে তার নাটক, চলচ্চিত্র, গান ও সাহিত্য নিয়ে দিনভর বিশেষ অনুষ্ঠান।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *