কুড়িগ্রামে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আরিফুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৩ টার রিপোর্ট অনুযায়ী, কুড়িগ্রামে সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ অবস্থায় জেলার ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়নের আড়াই শতাধিক চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ। যাদের ঘর-বাড়ি বিছানাপত্র সবকিছুই পানিতে তলিয়ে গেছে। তারা ঘর-বাড়ি ছেড়ে পাকা সড়ক, উঁচু বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। আর যাদের কোন রকমে থাকার উপায় আছে তারা কষ্ট করে পরিবার পরিজন নিয়ে বন্যার পানির মধ্যে ঘর-বাড়িতেই অবস্থান করছে। পাকা সড়ক, উঁচু বাঁধ এবং খোলা আকাশের নীচে পলিথিনের তাবু টানিয়ে বসবাসকারী পরিবারগুলো অব্যাহত বৃষ্টিতে কষ্ট করে জীবন-যাপন করছে।
বন্যা কবলিত এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম দফায় প্রায় দুই সপ্তাহের বন্যার সময়ও কিন্তু তারা পানিবন্দি জীবন-যাপন করেছে। দ্বিতীয় দফার বন্যার কবলে পড়া কর্মহীন এসব মানুষের মাঝে খাদ্য সংকট চরম আকার ধারন করেছে। বিশেষ করে চুলা জ্বালাতে না পারায় শুকনা খাবারের সংকটে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষজন। এসব এলাকার কাঁচা পাকা সড়ক তলিয়ে থাকায় ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার গড়ের পাড় মরাকাটা গ্রামের- শান্তি মিয়া, বুলবুলি ও শহিদা জানান, বাড়ীতে পানি উঠায় বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়েছি। গরু ছাগল, হাস মুরগি বাঁধের উপর নিয়ে এসেছি। কিন্তু ঘরের আসবাব পত্র, শুকনা খড়ি, চাউল সব পানির নীচে।
কুড়িগ্রাম পৌর এলাকা হানাগড়ের মাথা গ্রামের শ্রী স্বপন, কবিতা ও কৃষ্ণা জানান, বানের পানিতে বাড়ি ঘর সব কিছু ডুবে গেছে। আসবাব, খাদ্যসামগ্রী সব কিছুই পানির নীচে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুবই দূর্ভোগে আছি।
কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার একতা পাড়া বাঁধের পাড় গ্রামের রহিমা জানান, আমার বাড়ীঘর ডুবে যাওয়ায় প্রতিবেশী ফজিরনের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছি সে বাড়িও ডোবার পথে। গরু ছাগল অন্যত্র রেখেছি।
চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু হানাফি জানান, আমার ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। ৫টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসী মানুষে পরিপূর্ণ। তবে বড় সমস্যা নদী ভাঙ্গন।
কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোঃ দেলোয়ার হোসেন জানান, আমরা গত বন্যায় সরকার থেকে যা বরাদ্দ পেয়েছি তা বানভাসীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। যারা এখনো পায় নাই বরাদ্দ পেয়েছি তাদের কে দেয়া হবে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে এই বন্যা দুর্গত মানুষদের হাতে দীর্ঘদিন তেমন কাজ না ছিল। তার উপর প্রথম দফা বন্যা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আবারো বন্যা আসলো। চরে বসবাসকারী বেশিরভাগই অভাবী মানুষ। মূলত এই দিন মজুর শ্রেনীর মানুষেরাই খাদ্য সংকটে পড়েছে। এদের এই মুহুর্তে শুকনো খাবারের প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: সোউগ কিছু ভাসি গেইছে, খালি জীবন নিয়্যা সতরি আচ্ছি
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন জানান, আমার ইউনিয়নের ৪ হাজার পরিবারের ২৮ হাজার মানুষই পানিবন্দি জীবন-যাপন করছে। ২য় দফা বন্যায় জেলা প্রশাসন থেকে আমার ইউনিয়নের জন্য ৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা বুধবার উত্তোলন করে বিতরণ করা হবে। এই ৫ টন চাল ১০ কেজি করে মাত্র ৫০০ পরিবারকে দেয়া সম্ভব হবে।
কুড়িগ্রাম সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোঃ সাইদুল রহমান জানান, আমার ইউনিয়নে ১৪ হাজার পরিবার পানি বন্দি জীবন যাপন করছে। তাছাড়াও ধরলা নদীতে ২৫-৩০ টি বাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। ৩০০শ পরিবারকে দেয়ার জন্য ১০ কেজি করে চাল বরাদ্দ পেয়েছি তা বিতরণ করা হবে।
ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গঁসোনাহাট ইউনিয়ন (ইউপি) চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান আলী মোল্লা জানান, আমার ইউনিয়নের ৬টি গ্রাম পানিবন্দি হয়েছে। গতকাল ১শ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছি। আরও ত্রাণ সহায়তা হাতে পেলে বানভাসী মানুষ গুলির মাঝে বিতরন করবো।
উলিপুর উপজেলার দলদলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মোঃ আতিয়ার রহমান মুন্সী জানান, আমার ইউনিয়নের চারটি চর ইতিমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি দেখে বানভাসি মানুষ গুলোকে উঁচুস্থান বা আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হবে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো: রেজাউল করিম জানান, জেলায় বন্যা কবলিত মানুষের জন্য ৯ উপজেলায় ১৬০ মেট্রিক টন চাল, শুকনো খাবারের জন্য ৪ লাখ জিআর ক্যাশ, শিশু খাদ্যের জন্য ২ লাখ, গো-খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা বিতরণ কার্যক্রম চলছে।