গণপরিবহন সচলে গণমনে নানা প্রশ্ন

সমগ্র দেশে যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল বিস্তৃত হচ্ছে ঠিক তখনি গণ পরিবহন চলাচলের অনাপত্তিপত্র দিয়েছে সরকার। এমতবস্থায় বন্দরনগরী চট্টগ্রাম জুড়ে দৃশ্যমান শঙ্কার ছাপ, উঠে আসছে নানা প্রশ্ন।

দেশের শিল্পকারখানাগুলোতে কাজ করে লাখ লাখ শ্রমিক। তাদের যাতায়াতের একমাত্র বাহন গণপরিবহন। তাছাড়া খুলে দেওয়া হচ্ছে অফিস-আদালত। গণপরিবহনে কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। দীর্ঘদিন পর গণপরিবহন চালু হওয়ার ফলে দেখা দিতে পারে যাত্রী হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রবণতা। এমনিতেই গণপরিবহন সংকট থাকে সকসময়, ৩০ জনের বাসে উঠে ৫০-৬০ জন। লেগুনা-হিউম্যান হলারের পা-দানিতে বাদুড় ঝুলা ঝুলে চার-পাঁচ জন। গাদাগাদি করেই মানুষ প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে কর্মস্থলে। ফলে অফিস, কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালুর পর গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হবে কি— এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে এখন সাধারণ মানুষের মনে।

টানা দুই মাসের বেশি সাধারণ ছুটি শেষে (৩১ মে) থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালুর ঘোষণা আসে। বৃহস্পতিবার (২৮ মে) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সহকারি সচিব তৌহিদ ইলাহী স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

একই দিন সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবনে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে, গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মন্তব্য করেন।

রোগ সংক্রমণের হার সুনির্দিষ্টভাবে না কমার আগে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু করার ফলে সংক্রমন বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা ব্যক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অনেকের মতে, এ সময় গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। গণপরিবহন সংকট ও অসচেতন চালক, হেলপারের অবহেলায় গণপরিবহনে কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মানা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

স্বাভাবিক সময়েও গণপরিবহন সংকটে প্রতিদিন মানুষের বড় একটি অংশ ভোগান্তি সহ্য করে আর দ্বিগুণ ভাড়ায় ছোট যানবাহনে যাতায়াত করেন। সেখানে সীমিত পরিসরে সিটের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহনে মানুষ কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাতায়াত করবে তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে।

সংক্রমণ ঠেকাতে পুলিশের জারি করা নিয়মিত যানবাহনের সিট, হাতল, জানালা জীবাণুনাশক দিয়ে ধোয়া, চালক ও হেলপারের মাস্ক পরিধান ও যানবাহন চলাচলের সময় দরজা বন্ধ রাখার মত শর্তগুলো মানা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে চলছে বিতর্ক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহন শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি ও আইন মানার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। এই মুহুর্তে রয়েছে করোনাকে পুঁজি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানি বেড়ে যাওয়ার আশংকা। নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রী উঠানামা ও শারীরিক দূরত্ব মেনে সারিবদ্ধভাবে যানবাহনে উঠার ক্ষেত্রে যাত্রীদেরও সচেতনতার অভাব রয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা মহামারির সময় গণপরিবহন চলাচলে সিদ্ধান্ত আত্মাঘাতী। তারপরেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহন সংখ্যা বাড়ানো, ভাড়া নৈরাজ্য রোধ, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করাসহ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘জনসমাগম যেখানে বেশি সেখানে করোনা সংক্রমণ হয়। তাই আমাদের করোনা ঝুঁকি থেকে বাঁচতে জনসমাগম এড়িয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে জনসমাগমে যাতায়াতের সময় মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’

পূর্বাঞ্চলীয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মৃণাল চৌধুরী বলেন, ‘করোনার সময় সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল কতটুকু সম্ভব তা এখন বলা মুশকিল। সামাজিক দূরত্ব মেনে গণপরিবহনে যাত্রী পরিবহন নিশ্চিতে যাত্রী, মালিক, চালক, হেলপার, প্রশাসন মিলে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। রুটভিত্তিক গণপরিবহন নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। যানবাহন নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা ও সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে।’

জরুরি সংকটের সময়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতি কঠোর থাকতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ।

তারা বলেন, করোনা মহামারী ও লকডাউন চলাকালে সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার থমকে আছে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত ভাড়া জনগণের জীবন-যাত্রায় নতুন ভোগান্তি যোগ করবে। দীর্ঘদিন কর্মহীন পরিবহন শ্রমিকদের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি ও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে গণপরিবহন চালুর ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে সংশ্লিষ্টদের কঠোর থাকা জরুরি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *