গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার এখনই সময়

গতবছরের ডিসেম্বরে চীনে সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হবার পর অতি দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। এই ভাইরাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হচ্ছে এতি অতিমাত্রায় ছোয়াচে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ানোর পাশাপাশি এটি ব্যক্তির চারপাশের বস্তুতেও অবস্থান করতে পারে এবং সেখান থেকেও সংক্রমিত হতে পারে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সারাবিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পরামর্শ হল ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, অপ্রয়োজনে ঘরের বাহিরে বের না হওয়া, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে ঘরের বাহিরে বের হওয়া ইত্যাদি। মূলত উল্লিখিত পরামর্শের কারণে বিশ্বব্যাপি অতি দ্রুত জীবনযাত্রার প্রনালী বদলে যায়।

বিশ্বব্যাপী জরুরী কিছু সেবা ছাড়া অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়, যা এখনও চলমান। বেকার হয়ে পড়েন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের দুইমাসের সাধারণ ছুটি তথা অঘোষিত লকডাউনের কারণে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন এবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নেমে আসতে পারে ২ শতাংশের নিচে যা গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৮.১৫ শতাংশ (সুত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো)। তৈরি পোশাক খাতে বৈদেশিক আদেশ বাতিল হয়েছে ৫০০ কোটি ডলারেরও বেশি। ৯ লাখের বেশি লোক বেকার হয়ে পড়েছে। কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত মিলিয়ে মে মাস পর্যন্ত ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমান ১ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প আর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেনীর লোকজন।রাজধানী ঢাকার ৩৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে ফিরে গেছেন যারা কর্ম হারিয়েছেন এবং এই মুহুর্তে ঢাকাতে ফিরে আসার মত অবস্থা নেই। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাদের শ্রমশক্তি ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার।

কৃষিকাজের বিকাশ: ২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সাধারণ ছুটি ঘোষনার পরই রাজধানীবাসীরা ঢাকা ছাড়তে শুরু করে। রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ বাসিন্দা চলে যান নিজ গ্রামে। ঢাকার বস্তিাবাসি আর দিনমজুর শ্রেণীর লোকেরা যারা গ্রামে ফিরে গেছে তাদের ভাগ্য ফেরাতে গ্রামেই তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর ‘একফালি জমিও যেন পড়ে না থাকে’ এই নির্দেশের কঠোর বাস্তবায়ন করতে কৃষিকাজের বিকল্প নেই। ফসল ও সবজি চাষ, মাছ চাষ, পশুপালন ও দুগ্ধখামারের মত কর্মসংস্থানে মনোনিবেশ করতে হবে। গ্রামের নদী-নালা, পুকুর-ডোবা, হাওড়-বাওড়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে। কাজে লাগাতে হবে অনাবাদি প্রতিখন্ড জমি। রাজধানীতে এসে ভাসমান জীবনযাপন করার চেয়ে গ্রামে এধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়া অনেক যৌক্তিক। তবে এজন্য গ্রামবাসীদের মানসিকতার পরিবর্তন ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন।

ক্ষুুদ্র ও কুটির শিল্পের পুনঃবিকাশ: কৃষিকাজের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের দিকেও আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে এরকম শিল্প যেমন: মৃৎশিল্প, কাঠের কাজ, বাশ ও বেতের কাজ, নকশি কাথা, তাতবস্ত্র শিল্প ইত্যাদি। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উপর নির্ভর করে আছে ৩০ লাখের বেশি জনবল। বর্তমানে বছরে ৫৫ হাজার কোটি টাকা অবদান রেখে চলেছে এই শিল্প। দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত পন্য রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, স্পেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইডেন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, রপ্তানীমুখী শিল্প হিসেবে এই শিল্পের যথেষ্ট কদর রয়েছে যা উপযুক্ত পৃষ্টপোষকতা পেলে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে আমাদের অর্থনীতিকে।

তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বাজারজাতকরণের বিস্তুৃতি: গ্রামে উৎপাদিত পন্য যাতে সহজেই শহরে আসতে পারে আবার গ্রামে যাতে কাচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হয় সেই ব্যবস্থা করতে বাজারজাতকরণের সহজিকীকরণের প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে। ডেলিভারী চ্যানেলকে শক্তিশালি ও বিস্তুৃত করতে দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন: গ্রমীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেটের বিস্তৃতি জরুরী। পাশাপাশি ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে জাতীয় অবদানের জন্য শক্তিশালি হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তৃণমূল পর্যন্ত ই-কমার্সের বিস্তুৃতি: ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার সাথে ই-কমার্সের যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। তৃণমূলে উৎপাদিত পন্য সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌছে দেওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে কাজ করবে ই-কমার্সের বিস্তৃতি। রাজধানীতে আমরা যেভাবে ই-কমার্স ব্যবহার করতে শরু করেছি সেই ই-কমার্সকে গ্রামে পৌঁছে দিতে হবে। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র এক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের কর্মভিত্তিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ই-কমার্সকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে ই-কমার্স ব্যবহার করা গেলে গ্রামে কেন নয়?

তৃণমূলে অনলাইনে কাজের সুযোগ সৃষ্টি: এর জন্য প্রথমত প্রয়োজন নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ও মানসিকতার পরিবর্তন। সহজ কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমে গ্রামে বসেই সারাবিশ্বের কাজ করা সম্ভব। ‘ডিজিটাল ইকোনমাই রিপোর্ট-২০১৯’ এর তথ্যমতে দেশে বছরে ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে ৮৫০ কোটি টাকা আয় হয়। করোনা পরিস্থিতিতে আমরা শিখেছি কিভাবে বিকল্প পথে অফিসের কাজ করা যায়। ‘ Work from home’ পদ্ধতিতে ঘরে বসে কাজ করা সম্ভব হলে গ্রামে বসেও তা করা সম্ভব। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে নিজেদের কাজগুলোকে ‘Work from home’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা। এতেকরে নির্দিষ্ট কিছু কর্মীকে গ্রামে/ঘওে বসেই কাজ করার সুযোগ দেওয়া যাবে। এতে প্রতিষ্ঠানের যেমন বেতন বাবদ খরচ কম হবে তেমনি কর্মীও সন্তুষ্ট থাকবে।

ঘরে ফেরা কর্মসূচী জোরদারকরণ: ঢাকা শহরে ৭ লাখের মত মানুষ শুধু বস্তিতেই সববাস করে যাদের নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড এর একটি জরিপ বলছে, ঢাকায় হকার, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, নির্মান শ্রমিক, রিকশাচালক সহ ৭০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ অস্থায়ী বাসিন্দা। এরা ঢাকা শহরে মানবেতর জীপনযাপন করে, ঢাকার যানজট ও জনজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়ায়, পরিবেশ দূষনেও তাদের ভূমিকা রয়েছে আবার এরা বিভিন্ন অপরাধের সাথেও নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। কিন্তু এদেরকে গ্রামে পূনর্বাসনের মাধ্যমে একদিকে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালি করা সম্ভব হতো পাশাপাশি ঢাকা শহরের উপর থেকেও চাপ কমানো যেতো। ২৫ মার্চ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ঘরে ফেরা কর্মসূচী জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে যা একটি সুসংবাদ। এখন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে এর সঠিক বাস্তবায়ন ও যাদের জন্য এই কর্মসূচী তাদের মানষিক প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণই পারে এই কর্মসূচীর সফলতা বয়ে আনতে।

সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ: গ্রামাঞ্চলে যারা কৃষিকাজ ও কুটির শিল্পভিত্তিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে চান তাদের জন্য সরকার ব্যাংক হতে সহজ শর্তে ঋণগ্রহণের ব্যবস্থা চালু করেছে। মাত্র ৪ শতাংশ সুদে কৃষকেরা এই ঋণ নিতে পারবেন যেকোন ব্যাংক থেকে। কৃষিখাতে চলতি মূলধন সরবরাহের লক্ষ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৮ মাস মেয়াদী এই ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৪ শতাংশ।

মানসিকতার পরিবর্তন: তবে সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের মানষিক পরিবর্তন। আমরা যদি বিকল্পভাবে ভাবতে না পারি তাহলে আবার সেই অতীতেই ফিরে যেতে হবে। করোনা আমাদের বিশ্বকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের বুঝিয়েছে যে, আমাদের কি করা উচিত ছিল।

লেখক: সাজ্জাদ হোসেন রিজু
ব্যাংক কর্মকর্তা, ঢাকা।
ই-মেইল: sazzaddx@yahoo.com
ফোন: ০১৫৫৮৮৫২৩৩৬.

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *