টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে ধান ক্ষেতে আলোক ফাঁদের ব্যবহার

ছবি: রবিন তালুকদার

চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে একটি ধানের জমির পাশে আলো জ্বলছে। আলোকে ঘিরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। কৌতুহলের কারণে আলোর কাছে এসে দেখা গেল একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ১০ জন কৃষকদের সাথে কথা বলছেন। কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আলোক ফাঁদ করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় আলোক ফাঁদ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমন ধানে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও দমন করার খবরটি আশান্বিত হওয়ার মতোই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় দেলদুয়ার উপজেলার কৃষকেরা গত ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪টি ব্লকে আলোক ফাঁদ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছেন।

আলোক ফাঁদ প্রযুক্তিটি হচ্ছে রাতের বেলায় ক্ষেতের পাশে বৈদ্যুতিক বাল্ব বা চার্জার বাল্ব টাঙানো হয়। বাল্বের নিচে পাত্র রাখা হয়। ওই পাত্রের মধ্যে ডিটারজেন্ট বা কেরোসিনমিশ্রিত পানি থাকে। আকৃষ্ট হয়ে পোকামাকড় আলোর কাছে আসে এবং পাত্রের পানির মধ্যে পড়ে মারা যায়। ওই পোকামাকড় দেখে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উপস্থিতি নির্ণয় করা হয়। দেলদুয়ার উপজেলার কৃষকেরা এরই মধ্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল পেতে শুরু করেছেন।

ধানগাছে পোকামাকড়ের আক্রমণ স্বাভাবিক হলেও ফলনের জন্য তা খুবই ক্ষতিকর। ধানগাছে বাদামি ঘাসফড়িং, সবুজ ঘাসফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকা, গান্ধী পোকা, মাজরা পোকাসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর পোকা আক্রমণ করে। এর মধ্যে বাদামি ঘাসফড়িং বা কারেন্ট পোকা সবচেয়ে ক্ষতিকর। এ পোকা যে গাছে আক্রমণ করে সেই গাছের শীষ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে ফলন কমে যায়। অনেক সময় ফলন নেমে আসতে পারে শূন্যের কোঠায়। সাধারণত ধানে কাইচ থোড় আসার আগে এসব পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দেয়। আমাদের দেশে এসব পোকামাকড় মারার জন্য কৃষকেরা সাধারণত বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করেন। অথচ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ধান চাষে কীটনাশক ব্যবহার করে কৃষকেরা কোনো সুবিধা পান না। উৎপাদন তো বাড়েই না, বরং উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। আর এর পাশাপাশি পরিবেশও দূষিত হয়। এ ক্ষেত্রে আলোক ফাঁদ প্রযুক্তি ভালো বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কেননা, এতে খরচ কম হয় এবং পরিবেশবান্ধবও বটে।

দেলদুয়ার উপজেলার কৃষকদের অনুসরণে দেশের অন্যান্য স্থানের ধানচাষিরা ধানগাছের পোকামাকড় দমনে ও পোকার উপস্থিতি জানতে আলোক ফাঁদ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন। এ জন্য এই প্রযুক্তির ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে কৃষকদের মাঝে প্রচারণা চালাতে হবে। দেলদুয়ার উপজেলার দেউলি ইউনিয়নের আগদেউলী গ্রামের কৃষক নয়া মিয়া বলেন, আমাদের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার আলোক ফাঁদ করে আমাদের ধানের ক্ষতিকর ও উপকারী পোকা চিনিয়ে দিচ্ছেন। সাথে কি ব্যবস্থা নিতে হবে তা বলে দিচ্ছেন। একই গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আলোক ফাঁদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি আমার জমিতে কি কি পোকা রয়েছে। সাথে সাথে পোকাগুলোও মারা যাচ্ছে। আলোক ফাঁদ পোকা মারার খুব ভাল পদ্ধতি। আমি এখন থেকে সব সময় এই ফাঁদ ব্যবহার করব।

দেউলি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার ফারহানুল কবির বলেন, আলোক ফাঁদ পোকামাকড়ের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও দমন করার পরিবেশবান্ধব কার্যকরী একটি প্রযুক্তি। আমি প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কৃষকদের নিয়ে আলোক ফাঁদ করেছি। এতে কৃষকদের পোকা দমনের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থাপত্র দেয়া সহজ হয়।

এ বিষয়ে দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি অফিসার শোয়েব মাহমুদ বলেন, আলোক ফাঁদ পোকার উপস্থিতি ও দমনের একটি কার্যকরী পদ্ধতি। দেলদুয়ার উপজেলার ২৪টি ব্লকে প্রতি রবিবার একযোগে সন্ধ্যার পর আলোক ফাঁদ করা হয়। এতে করে উপজেলায় ধানে কি কি পোকা রয়েছে, তা আমরা আগাম জানতে পারি। ফলে পোকা ক্ষতি করার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়। এছাড়া আমরা কৃষকদের নিজ উদ্যোগে আলোক ফাঁদ করার জন্য পরামর্শ প্রদান করে যাচ্ছি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *