পঁচাত্তরের কালরাত্রি ১৫ই আগস্ট, কেঁদেছে গোটা বিশ্ব

প্রতীকি ছবি

শিপন নাথ:  ১৫ আগস্ট মানেই শোকের ছায়ায় নিমজ্জিত একটি তারিখ। দিনটি এলেই বাঙালির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণে-শ্রদ্ধায়, কান্নায়, ভালোবাসায় বারবার অবনত হয় মাথা। কয়েকজন বর্বর সেনা কর্মকর্তা, বর্বরোচিত অভিলাষ পূরণে যে ঘৃণ্য ইতিহাস গড়েছিল, তার মর্মবেদনা বাঙালিকে বয়ে বেড়াতে হবে অনন্তকাল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে এসেছিল তীব্র শোকের ছায়া। ছড়িয়ে পরেছিল হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণার বিষ বাষ্প। হত্যার খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল বিশ্বসম্প্রদায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২৮ আগস্ট ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় লিখেছিল, ‘১৫ আগস্টের ঘটনার ভেতর দিয়ে যেন বাংলাদেশের জনগণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রচারণা এবং সামরিক শাসনের কালে প্রত্যাবর্তন করেছে।’

১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়, ‘১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান ও শেখ মুজিবের হত্যার পর গণতান্ত্রিক আমলের অবসান হয়।’ ফিন্যান্সিয়াল টাইমস্ উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’

পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’

১৫ আগস্টের ঘটনার পর বিবিসি প্রকাশ করে, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’

ভারতের বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছেন। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’

ঘটনার পরদিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’ অপরদিকে নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে।’

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’

বৃটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’

বৃটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’

কিউবার বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’

ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’

ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ইয়াসির আরাফাত বলেছিলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’

জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউন্ডা বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’

বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার খবর শুনে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাঙ্ক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মত তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’

এছাড়াও অনেক গণমাধ্যম ও বিশিষ্টজন আক্ষেপ করেছেন। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় তার কবিতায় লিখেছেন- ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা- গৌরী যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার- শেখ মুজিবুর রহমান।’

আজকের এ শোকের দিনে নত শিরে শ্রদ্ধা জানাই সেই মহান নেতার প্রতি। বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই ৭১ এর চেতনা। বঙ্গবন্ধু থাকবেন বিশ্বজুড়ে। থাকবেন এ দেশের ঘরে ঘরে, প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে- চির নস্বর , চির অম্লান।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *