বর্ষার সঙ্গী কদম ফুল

হাসানুজ্জামান হাসানঃ এসেছে কদম ফুলের দিন। চলছে আষাঢ়। বৃষ্টি যদিও থেকে থেকে ঝরেছে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে। তবুও বর্ষার নিজের মাস আষাঢ়। আর আষাঢ়ের বর্ষা-প্রকৃতির অনন্য অলঙ্কার কদম ফুল। কদম যেন বর্ষা ঋতুর প্রতীক। এবারের গ্রীষ্ম আগুন নিয়ে এসেছিল শহর-গ্রামে সবখানে। 

বর্ষা ঋতুর প্রথম প্রহরেই কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে, প্রকৃতি প্রেমীদের মাঝে কদম ফুল নিয়ে বেশ মাতামাতি হয়। লেখালেখি হয় কবিতা ছড়া গল্প। বর্ষায় কদম ফুল এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আছে। কদম ফুলের রূপ-সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে আবেগ-অনুভূতি ভালোলাগা ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে তৈরি করেন কদম ফুলের সম্মোহনী উপখ্যান। কদম ফুল নিয়ে আমার যেমন শৈশব-কৈশোরে বহু স্মৃতি রয়েছে তেমনি কদম ফুল নিয়ে নানা তথ্য উপাত্ত জেনেছি এই সময়ে এসে। বর্ষা যেমন প্রকৃতিতে সূচি শুদ্ধতা দিয়ে আসে তেমনি বর্ষার অলংকার হিসেবে কদমফুল তার আপন মহিমায় নিজেকে সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে মেলে ধরে। কদম্ব বা কদম ফুল যে নামেই ডাকা হোক অন্যান্য ফুলের এত নামডাক নেই বর্ষা ঋতুতে।

ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজে কদমফুল নিয়ে যেমন মাতামাতি করেছি তেমনি কদম ফুলে গাছের ছাল পাতার ঔষধি ব্যবহার জেনেও অবাক হয়েছি। বর্ষায় কদম ফুলের পাপড়ি আলাদা করে একে অপরের গায়ে ছিটিয়ে কি যে আনন্দ উদ্দীপনায় মেতে থাকতাম।

বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে আসে কদম ফুল। কদম যেন বর্ষার দূত! আষাঢ়ের সঙ্গে কদমের সম্পর্ক নিবিড়। সাধারণত আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতেই কদম ফোটে। প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে কদম ফুল। গোলাকার সাদা-হলুদ রঙের ফুলটি দেখতে ছোট বলের মত। গাছ ভরে এই ফুলের সমাহার ঘটে। সেই মুহূর্তটি এক অপূর্ব সৌন্দর্যের।

বর্ষার আগমন যখন চারপাশে, তখন তার সঙ্গী হতে গাছে গাছে দেখা মিলে আরেক অতিথির। গ্রীষ্মের প্রখরতা কমাতে যখন আম, জামসহ নানা ফলের ঘ্রাণে মুখর চারপাশ, তার পরই আগমন ঘটে বর্ষার সঙ্গী কদম ফুলের।

কদমের সংস্কৃত নাম কদম্ব। কদম্ব মানে হলো দয়া, বিরহীকে দুঃখী করে! প্রাচীন সাহিত্যের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে কদম ফুল। মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্য জুড়ে রয়েছে কদমের সুরভী মাখা রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাঁথা! ভগবত গীতা থেকে শুরু করে লোকগাঁথা, পল্লীগীতি ও রবীন্দ্র-কাব্য পর্যন্ত কদম ফুলের উল্লেখ রয়েছে। ভানুসিংহের পদাবলি, বৈষ্ণব পদাবলি ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে নানাভাবে নানা আঙ্গিকে এসেছে কদম গাছের কথা। বহুল উপমায় বিভূষিত তার গুণগাথা।

কদম গাছ নিয়ে গ্রামবাংলার নানা ছড়া-কবিতাও রয়েছে। ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদম তলায় কে/হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে সোনামণির বে’- এমন বহু ছড়ায় এখনও কদমের সুষমা প্রকাশ পায় মানুষের মুখে মুখে।

আকাশজুড়ে কখনও কালো মেঘের ঘনঘটা কিংবা এক চিলতে রোদের মুখ কালো মেঘের ভিড়ে অথবা হঠাৎ করেই মুষলধারায় বৃষ্টি! জ্যৈষ্ঠের প্রখর রোদের পরে এমন প্রশান্তিই বলে দেয় বর্ষাকালের আগমন বার্তা। আষাঢ়-শ্রাবণ মূলত এ দুই মাস বর্ষাকাল। বাংলার পল্লী প্রান্তরে কদম গাছ দেখতে যায়। কদম গাছ দীর্ঘাকৃতি এবং বহুশাখাবিশিষ্ট।

রূপসী তরুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কদম: কদম ফুল দেখতে বলের মতো গোল, মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস। এই ফুলের রং সাদা-হলুদে। তবে পাপড়ি ঝরে গেলে শুধু হলুদ রঙের গোলাকার বলের মত দেখা যায়। এই গাছের ফল মাংসল, টক এবং বাদুড় ও কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাদ্য। যদিও কাঠ বিড়ালী এখন বিলুপ্ত প্রাণী। বাদুড় এ অঞ্চল থেকে প্রায় বিলুপ্তির পথে।

কদম গাছের ফুল ছাড়া আরও রয়েছে ফল। এ ফলগুলো দেখতে অনেকটা লেবুর মতো। কদম গাছের পাতা শীতকালে ঝরে যায় আর কচি সবুজ পাতা নিয়ে আগমন ঘটে বসন্তের। কদম ফুলের আছে আরও অনেক নাম। ললনাপ্রিয়, সুরভী, কর্ণপূরক, মেঘাগমপ্রিয়, বৃত্তপুষ্প ছাড়াও নীপ মানে পরিচিত এ কদম ফুল।

কদমের একেকটি গাছ ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এর সবুজ ঝরঝরে পাতার মাঝে থাকা গোলাকার কদম ফুল বর্ষা স্নানে আরও রূপসী হয়ে উঠে। কদম ফুল ছাড়া কদম গাছও বেশ উপকারী। সরু সবুজ পাতার ডালে ডালে গোলাকার মাংসলো পুষ্পাধার আর তার থেকে বের হওয়া সরু হলুদ পাপড়ির মুখে সাদা অংশ কদমকে সাজিয়ে তুলেছে ভিন্নভাবে।

একটি ফুলের মাঝে এত ভিন্নতার ছোঁয়াতে কদমফুলকে করে তুলেছে আরও গ্রহণযোগ্য। ফুলে ভরা কদমগাছ দেখতে অসাধারণ হলেও এর আর্থিক মূল্য তেমন একটা নেই। তাই কেউ এর গুনগত মান বুঝে না।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *