বানান আন্দোলন-এর পক্ষ থেকে খোলা চিঠি

বাংলা ভাষা চর্চার অন্যতম বৃহৎ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বানান আন্দোলন ইতোমধ্যেই সারা দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বানান আন্দোলনকে নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক নানান মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যখন সরগরম, এমনই এক সময়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাভাষী সকল মানুষের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে।

চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

সবাইকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত।
আশা করি প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে ভালো আছেন, সুস্থ আছেন।

আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে আমার মাথার মধ্যে একটা পোকা ঢোকে। শুরুতে ভেবেছিলাম- পোকাটা ঢুকেছে; পরে উপলব্ধি করলাম- না, এই পোকাটা অনেক ছোটো বয়স থেকেই ধীরে ধীরে আমার মন-মগজে জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে এসে সে পোকাটা চলতে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে, প্রতিবাদ করার সাহস সঞ্চয় করেছে।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ-এর নামের বানানে ভুল দেখার পর থেকে পোকাটা কেমন করে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে জাগ্রত হয়ে ওঠে হঠাৎ করে, সে সময়টাতে। এক দারুণ যন্ত্রণায় আমার রাত্রি জাগা শুরু তখন থেকেই। কেননা যেদিকেই তাকাই, সেদিকেই কেবল ভুল দেখতে পাই; ভুল আর ভুল। ভুলটা কীসের? বাংলা শব্দের বানানে। যেখানে দেশের একটা বড়ো অংশ মনে করেন- ‘বানান ভুল কোনো ব্যাপার না’, সেখানে এ বিষয়টা নিয়ে কাজ করাটা যে একটা ‘আন্দোলন’-এর চাইতে কম কিছু হবে না, তা আমি শুরু থেকেই বুঝতে পারতাম। একান্ত ব্যক্তিগত যন্ত্রণাবোধের জায়গা থেকে সে সময় ‘বানান আন্দোলন’ নাম দিয়ে ফেইসবুকের মাধ্যমে বানান-সচেতনতা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। সে সময় সত্যিই জানতাম না- আমি এটা নিয়ে কী করতে পারবো। কেননা কাজ শুরু করার পর থেকে অসংখ্যবার মানুষ কণ্ঠ দিয়ে আমাকে অত্যন্ত বাজেভাবে আক্রমণ করেছেন। কষ্ট পেয়েছি এ কারণে যে, যে ভাষার সাহায্যে তারা আমাকে আক্রমণ করছেন, সে ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার ছড়িয়ে দিতেই আমি কাজ করছি; অথচ তারা সেটা বুঝতে পারছেন না। কত শতবার এ ধরনের আঘাতে আমাকে বিদ্ধ-বিক্ষত হতে হয়েছে, সে ইতিহাস বলে শেষ হবে না। সেদিকে আর যাচ্ছি না।

দীর্ঘদিন একরকম নীরবে-নিভৃতেই ‘বানান আন্দোলন’-এর কাজ চলছিল। যারা ভাষা বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন, তারা বানান আন্দোলনকে শক্তি-সাহস-অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আসছিলেন। ২০২০-এ এসে মনে হলো, এভাবে আসলে কিছু হচ্ছে না। শিশুকাল থেকে যে ভাষাটাকে হৃদয় দিয়ে আত্মস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছি, হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবেসে এসেছি, স্বীয় প্রচেষ্টায় যে ভাষার অতল অভ্যন্তরে ঢুকে তাকে পরিপূর্ণরূপে চিনে ওঠার জন্য সর্বাত্মক শ্রম দিয়েছি, তার শুদ্ধাচার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যা করছি, তা যথেষ্ট নয়।

নতুন উদ্যম নিয়ে কাজ শুরু হলো। ভাষার শুদ্ধাচারের এ আন্দোলনে শুরু থেকেই আমার সর্বাত্মক সহযাত্রী রেজবুল ইসলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- আঘাত করতে হবে। কাঠের শরীরে আঘাত না করলে আসবাব হয় না, লোহাকে না পোড়ালে তরবারি হয় না। আমরা সচেতনভাবেই জানতাম- আমাদেরও আঘাত সইতে হবে। জানতাম- ভাষার ব্যবহার বিষয়ে উদাসীন মানুষেরা, যারা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’-তে শহিদমিনারের বেদিতে ভুল বানানে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ লিখে ভাষাদিবস উদযাপন করেন, তাদের আঘাত আমাদের সইতে হবে। কিন্তু আমাদের চলার শক্তি ছিল অন্য জায়গায়। আমরা বিশ্বাস করেছি- বাংলা ভাষায় কথা বলা বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই তার পূর্বপুরুষের রক্তদানের ইতিহাস সঞ্চিত আছে; ভাষার প্রতি সীমাহীন আবেগ ধারণ করে তারা ভেতরে ভেতরেই কষ্ট পুষে নিয়ে হয়তো আমাদের মতো কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের বিশ্বাস ছিল- এ মানুষেরা আমাদের এ প্রচেষ্টায় আমাদের সঙ্গী হবেন।

গত কয়েক মাসে বানান আন্দোলন এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু এটা কীভাবে হলো? এটা সম্ভব হয়েছে সেই মানুষগুলোর জন্য, যারা হৃদয় থেকে ভাষার প্রতি মমতা অনুভব করেন; যারা বাংলাকে ভালোবেসে ‘বানান আন্দোলন’-এর হাত ধরে হেঁটেছেন, হাঁটছেন। আমি স্বীকার করে নিতে চাই- ‘বানান আন্দোলন’-ই বরং আপনাদের হাত ধরে এগোচ্ছে। আজ সারা দেশে তো বটেই, পৃথিবীর আরও অন্তত অর্ধশত দেশের বাংলাভাষীদের মধ্যে ‘বানান আন্দোলন’ যে সাড়া ফেলেছে, তার শতভাগ কৃতিত্ব ভাষার প্রতি আমাদের এ আবেগের, এ ভালোবাসার এবং ভাষা-সচেতন মানুষদের।

আমরা জানতাম- এ পথ কণ্টকাকীর্ণ। জানতাম- আঘাত আসবে। এসেছে। গত দু-মাসে বানান আন্দোলনকে আঘাত করে নানাবিধ আক্রমণাত্মক-হিংসাত্মক কথাবার্তা ছড়ানোর প্রচেষ্টা চলেছে, এখনও চলছে। কিন্তু জয়রথ থামেনি। কেননা ভালোবাসার শক্তি ঘৃণার আক্রমণের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী।

কিছু কিছু মানুষ বলতে চেয়েছেন- বানান আন্দোলন ‘উগ্রবাদী’, বানান আন্দোলন ‘উদ্ধত’। এ ভাষাটার জন্য এক সময় যারা আমার-আপনার পক্ষে লড়াই করেছেন, তাদেরকেও ‘উগ্রবাদী’-‘উদ্ধত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। যারা এ আখ্যা দিয়েছিল, তাদেরও এই একই ধারণা ছিল যে, ভাষা নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? তাদেরও এ-রকমই বিশ্বাস ছিল- অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বাঙালির আবেগ বেশি। না, যারা ‘বানান আন্দোলন’ বিষয়ে এ ধরনের মন্তব্য করছেন, তাদের প্রতি আমাদের কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই। আমরা বরং ইতিবাচকভাবে নিচ্ছি এই ভেবে যে- হিংস্রতার ‘উগ্রবাদ’ থেকে তাহলে আমাদের উত্তরণ ঘটছে। শুদ্ধতার ক্ষেত্রে ঔদ্ধত্য মঙ্গলজনক। বাংলাদেশের ইতিহাসের সকল সংগ্রাম-বিজয়ের গল্প সে কথাই বলে।

কিন্তু আঘাত তো এখানেই থেমে থাকেনি। পৃথিবীর সকল শুদ্ধাচার ও ন্যায়সংগত প্রচেষ্টাকেই পশ্চাৎপদরা ভয় পেয়ে এসেছে; ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এসেছে। তবে ভাষার শুদ্ধাচার নিশ্চিতের এ প্রচেষ্টা যে কারো কারো এতটা গাত্রদাহের কারণ হতে পারে, তা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। তারা এতটাই অস্থির হয়ে উঠেছেন যে রীতিমতো নানান ধরনের হুমকিধমকি দেওয়া শুরু করেছেন। কেন ভাই? এ হুমকিধমকি কী কারণে? আমরা চেষ্টা করছি মেধা দিয়ে; আপনিও মেধা দিয়ে আমাদের পরাজিত করতে পারেন, ভুল ‘প্রমাণিত’ করতে পারেন। কিন্তু এসব ‘উড়িয়ে দেবো’, ‘গুড়িয়ে দেবো’, ‘ভ্যানিশ করে দেবো’ আবার কী ধরনের আচরণ? আপনি ভাষার যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতেই পারেন, সেটাই হয়তো আপনার আবেগ; আপনার একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ। কিন্তু ভাষার শুদ্ধাচার বাংলাভাষীদের জাতিগত প্রাণের আবেগ। এ শুদ্ধাচার নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাবোই। আপনি ভুল ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করুন, সমস্যা নেই। আমরা সে ভুলগুলোকে ফুল বানিয়ে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেবো। এভাবে আসুন।

আমি সবাইকে জানিয়ে রাখতে চাই- ‘বানান আন্দোলন’-এর পেছনে যে মানুষগুলো কাজ করছেন, তারা প্রত্যেকেই নিঃস্বার্থভাবে এ কাজগুলো করে যাচ্ছেন। রাতদিন পরিশ্রম করছেন। প্রতিদিন শত শত মানুষের সহস্র প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। ব্যাখ্যা চাইলে ব্যাখ্যা, রেফারেন্স চাইলে পৃষ্ঠা নম্বর ধরে ধরে রেফারেন্স দিয়ে আস্থা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের তো এখান থেকে বিন্দুমাত্র কোনো বৈষয়িক প্রাপ্তি নেই। ভাষার শুদ্ধতার চর্চা নিশ্চিতে কিছু অবদান তারা রাখতে পারছেন- এ-ই তাদের একমাত্র প্রাপ্তি। চব্বিশ ঘণ্টা তাদের কেউ-না-কেউ জেগে আছেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো- কেউ যাতে জানতে চেয়ে শূন্য হাতে ফেরত না যান।

আঘাত আসছে, আসুক। সকল আঘাতকে আশীর্বাদ মেনে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। সারা পৃথিবীর যেখানে যে প্রান্তেই বাংলাভাষী মানুষ রয়েছেন, সবার কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চাই- বাংলা ভাষার শুদ্ধতা চর্চার এ সংগ্রাম চলবে। যত আঘাতই আসুক, আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন- এ আহ্বান জানিয়ে যেতে চাই। যারা দেশকে ও দেশের ভাষাকে ভালোবাসেন, তাদের সবাইকে আমরা পাশে পেতে চাই; সবাই মিলে ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চাই।

তাই, যাদের কাছে এখনও ‘বানান আন্দোলন’-এর তথ্য পৌঁছায়নি, যারা এখনও আমাদের এ পরিবারে সরাসরি যুক্ত হতে পারেননি; তাদের সবার কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ রইল। বাংলাপ্রেমী সকল মানুষকে ‘বানান আন্দোলন’-এ যুক্ত করার আহ্বান রইল।

সবার জন্য ভালোবাসা।

ওয়াহেদ সবুজ
প্রধান নির্বাহী
বানান আন্দোলন।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *