বীর মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমান পিতা-মাতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত

ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টাও ঝিনাইদহ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ মশিউর রহমান মঙ্গলবার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে ঝিনাইদহ শহরের গীতাঞ্জলী সড়কের নির্জন বাসার দরজা ভেঙ্গে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ ছোঁয়া ইসরাইল জানান অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুকালে মশিউর রহমানের বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। দুপুর ১২টার দিকে সাবেক এই সাংসদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শোকের ছায়া নেমে আসে ঝিনাইদহে। লাশ দেখতে দলমত নির্বিশেষে মানুষ ছুটতে থাকেন তার ক্যাসেল ব্রীজ সংলগ্ন নতুন বাড়িতে। এ সময় পুলিশ ও দলীয় নেতাকর্মীদের মানুষের ভীড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।

গাড়ি চালক নাজমুল হাসান বাধন জানান, মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে মশিউর রহমান তার অসুস্থতার কথা জানিয়ে দ্রুত বাসায় আসতে বলেন। বাঁধন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঝিনাইদহ শহরের গীতাঞ্জলী সড়কের বাসায় এসে ডাকাডাকি করতে থাকেন। আনুমানিক বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মশিউর রহমানের ছোট ভাই আসাদুজ্জামান, প্রতিবেশী ও পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শেখর, পাপপু সাহা ও ম্যানেজার বকুল হোসেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ঘরের দরজা ভেঙ্গে দেখেন সোফার উপর মশিউর রহমানের নিথর দেহ পড়ে আছে। তাকে উদ্ধার করে ইজিবাইকযোগে দ্রুত ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরী বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক ছোঁয়া ইসরাইল জানান অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
জানা যায়, মসিউর রহমান মৃত্যুর আগের দিন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামে তার বড় বোনের সাথে দেখা করেন। তার বড় ভাগ্নের কবর জিয়ারত করেন এবং বোনকে জড়িয়ে ধরে সমবেদনা জানান। সেখান থেকে এসে ওই এলাকায় তার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত আলহাজ্ব মসিউর রহমান ডিগ্রি কলেজ এর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বর্ষীয়ান এই নেতার বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা গেছে, তিনি ২৫ জুন ১৯৫৩ সালে ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের কন্যাদহ গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। মসিউর রহমান ৭ম শ্রেনীতে অধয়্যয়নরত অবস্থায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে আয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। মশিউর রহমান ১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গ্রেফতার হন এবং কয়েক মাস কারাবরণ করেন। ১৯৭১ সালে ৮ নং সেক্টরে হরিণাকুন্ডু থানা কমান্ডার হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মশিউর রহমান ঝিনাইদহ, হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা, কুষ্টিয়া ও আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নেওয়ার জন্যে ঝিনাইদহ আনসার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন ও সরকারী ভাবে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করেন। তিনি উক্ত ক্যাম্পের কমান্ডার নিযুক্ত হন। স্বাধীনতা পরবর্তী ঝিনাইদহে মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করে তিনি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করেন এবং উক্ত সংসদের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে শহীদ জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিএনপিতে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালে অল্প বয়সে তিনি হরিণাকুন্ডুর চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকায় ৭ মাস কারাভোগ করেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপির মনোনয়নে জাতীয় সংসদ সদস্য পদে লড়াই করে করে পরাজিত হন। সারা দেশে বিএনপির তিন’শ আসনের প্রার্থীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী। মশিউর রহমান ১৯৯১, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, জুন ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় তিনি বিরোধী দলীয় হুইপ, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কমিটি ও কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দূনীতির অভিযোগে মশিউর রহমানের নামে দূর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের করে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে যশোরের বিশেষ জজ আদালত অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাকে ১০ বছরের কারাদন্ড, জরিমানা ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রায় প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। মসিউর রহমানের স্ত্রী মাহবুবা রহমান শিখা পেশায় একজন আয়কর আইনজীবী। এই দম্পতির শামীমা রহমান শিমু, ডাঃ ইব্রাহীম রহমান, শোয়াইব রহমান নামে তিন সন্তান রয়েছে। তথ্য নিয়ে জানা গেছে, টানা চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলায় প্রথম বিসিএস নার্স ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি ঝিনাইদহ শহরে নার্সিং ইনস্টিটিউট, সরকারী শিশু হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, ম্যাটস, হেলথ টেকনোলজি, খাবার স্যালাইন ফ্যাক্টরী, ভেটেরিনারি কলেজ, ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত, করোনারী কেয়ার ইউনিট, ঝিনাইদহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে একাধিক কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসা স্থাপন করে নজীর স্থাপন করেন।
মশিউর রহমানের মৃত্যুর খবর পেয়ে আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য ও তার রনাঙ্গনের বন্ধু মোঃ আব্দুল হাই ও সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মকবুল হোসেন মৃতদেহ দেখতে ছুটে আসেন। হাজারো দলীয় নেতাকর্মী ও শুভান্যুধায়ীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মশিউর রহমানের মৃতদেহ এক নজর দেখতে তার বাড়িতে ভীড় করেন।
বুধবার ঝিনাইদহ সরকারি বালক বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সম্মান জানানো হয়। সেখানে বেলা সাড়ে ১১ টায় ১ম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়। পরে তার নিজ গ্রাম ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার কন্যাদহ গ্রামে ২য় জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে পিতা-মাতার কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়। এ বীরের মৃত্যুতে ঝিনাইদহের সর্বসাধারণের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *