ভেষজগুণে ভরপুর ডুমুর, এ গাছের ছাল ও পাতাতেও মিলবে উপকার

 

ছবি: সংগৃহিত

ডুমুর আমাদের দেশের অতিপরিচিত একটি ফল। শহরে-গ্রামে সব জায়গায় রাস্তার পাশে ডুমুরের গাছ জন্মে। ডুমুরের গাছের নিচে ডুমুর ফল পড়ে থাকে। তবে খুবই অবাক করা বিষয় হলো যে গাছের নিচে পড়ে থাকা একদম বিনে পয়সার এই ফলটি কিন্তু ভীষণ উপকারী। পাকা কিংবা কাঁচা, দুই অবস্থাতেই এই ফল খাওয়া যায়। হালকা মিষ্টি স্বাদের এই ফলের উপরিভাগ অনেক পাতলা এবং ভেতরে ছোট ছোট বীজ আছে। পাকা ডুমুর বেশ রসালো এবং হালকা মিষ্টি স্বাদযুক্ত। গরমে পাকা ডুমুরের জুস বেশ আরামদায়ক একটি পানীয়। পাকা ডুমুর দিয়ে জেলি এবং চাটনি তৈরি করা যায়। কাঁচা ডুমুর তরকারি হিসেবে রান্না করলে খেতে বেশ উপাদেয় এবং সুস্বাদু হয়।

ডুমুর কয়েক প্রজাতির হয়। বাংলাদেশে সচরাচর যে ডুমুর পাওয়া যায় (Ficus hispida) তার ফল ছোট এবং খাওয়ার অনুপযুক্ত। এর আরেক নাম ‘কাকডুমুর’। এই গাছ অযত্নে-অবহেলায় এখানে সেখানে ব্যাপক সংখ্যায় গজিয়ে ওঠে। গাছ তুলনামূলকভাবে ছোট। এটি এশিয়ার অনেক অঞ্চলে এবং অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। পাখিরাই প্রধানত এই ডুমুর খেয়ে থাকে এবং পাখির বিষ্ঠার মাধ্যমে বীজের বিস্তার হয়ে থাকে।

মধ্যপ্রাচ্যে যে ডুমুর (আঞ্জির) পাওয়া যায় (Ficus carica) তার ফল বড় আকারের। এটি জনপ্রিয় ফল হিসেবে খাওয়া হয়। বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ হয়ে থাকে আফগানিস্তান থেকে পর্তুগাল পর্যন্ত। এর আরবি নাম ‘তীন’; হিন্দি, উর্দু, ফার্সি ও মারাঠি ভাষায় একে ‘আঞ্জির’ বলা হয়। এই গাছ ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এর আদি নিবাস মধ্যপ্রাচ্য।

জগডুমুর বা যজ্ঞডুমুর নামে আরেক প্রজাতির ডুমুর রয়েছে, যার বৈজ্ঞনিক নাম Ficus racemosa. মূলত এই প্রকার ডুমুর তরকারি করে খাওয়া হয়। এটিও বাংলাদেশে পাওয়া যায়।

এছাড়া অশ্বত্থ বা পিপল নামে আরেকটি ডুমুর জাতীয় গাছ আছে, যার বৈজ্ঞানিক নাম Ficus religiosa. এটি বটগোত্রীয় বৃক্ষ, এর পাতার অগ্রভাগ সূচাল। এই ডুমুর গাছ দিয়ে বনসাঁই তৈরি করা যায়।

উপরিউক্ত প্রজাতি ছাড়াও ডুমুরের আরো অনেক প্রজাতি রয়েছে সারাবিশ্বে।

আসুন জেনে নিই খুবই সহজলভ্য এই ডুমুর ফলের পুষ্টিগুণ এবং উপকারিতা।

পুষ্টিগুণ:

ডুমুর অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি ফল। বিশেষ করে এনার্জি, ক্যালসিয়াম এবং আঁশে ভরপুর। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন বা এফডিএ-এর তথ্য মতে প্রতি ১০০ গ্রাম ডুমুরে কার্বোহাইড্রেট ৬৩.৮৭ গ্রাম, শর্করা ৪৭.৯২ গ্রাম, আঁশ ৯.৮ গ্রাম, ফ্যাট ০.৯ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৬২ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। এছাড়াও এতে আছে ভিটামিন বি, রিবোফ্লাবিন, নিয়াসিন, থায়োমিন, প্যান্টোথেনিক এসিড, ফোলেট, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়ামের মত উপকারী সব খনিজ উপাদান। যা আমাদের শরীরের জন্য ভীষণ প্রয়োজন।

উপকারিতা:

১. মায়েদের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে: ডুমুর ভাঙলে বা কাটলে একরকমের সাদা রস বের হয়। একে বলা হয় ল্যাটেক্স। এটাকেই ডুমুরের সকল শক্তি এবং উপকারিতার মূল উৎস বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। মায়েদের বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানোর জন্য উদ্দীপক হিসেবেও ব্যবহার করা হতো।

২. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে: ডুমুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম। পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। নিয়মিত ফল ও সবজি খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও আমরা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার খেয়ে থাকি। ডায়েটে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হাইপারটেনশনের সমস্যা হতে পারে। তাই ডায়েটে রাখুন ডুমুর ফল। এর পটাশিয়াম হাইপারটেনশন প্রতিরোধে সাহায্য করবে।

৩. ত্বকের পরিচর্যায়: ডুমুর খেলে আমাদের ত্বক উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এছাড়াও ত্বকে ব্রণের দাগ কিংবা যেকোনো দাগ মেশাতে ডুমুর বেশ কার্যকর। তাই যারা ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি কিংবা ত্বকের দাগ নিয়ে চিন্তিত তারা কিন্তু ডুমুর খেতে পারেন।

৪. চর্ম রোগে: ডুমুর বিভিন্ন চর্মরোগের জন্য অনেক উপকারী। এজন্য ডুমুরের ছাল পানিতে সিদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করলে ত্বকের বিবর্ণতা এবং ক্ষত খুব দ্রুত সেরে যায়। এছাড়াও ত্বকের ফাঙ্গাশ জনিত যেকোনো সমস্যয় ডুমুরের সিদ্ধ পানি অনেক উপকারী।

৫. হজম শক্তি বৃদ্ধিতে: ডুমুরের ছাল থেঁতো করে পানিতে সিদ্ধ করে এর সাথে যদি পুদিনা পাতার রস মিশিয়ে খাওয়া যায় তাহলে আমাদের হজমশক্তি অনেক বেড়ে যায় এবং একই সাথে আমাদের পাকস্থলীর কর্মক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পায়।

৬. ওজন কমাতে সাহায্য করে: খাদ্যআঁশ সমৃদ্ধ ডুমুর ওজন কমাতে সাহায্য করে। ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে আপনার খাদ্যতালিকায় ডুমুর রাখুন। ডুমুর বিদ্যমান পেকটিন রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।

৭. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, মেনোপজ পরবর্তী পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে ডুমুর সাহায্য করে। আঁশ সমৃদ্ধ ডুমুর খাদ্যতালিকায় রাখার ফলে ৩৪% মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কম দেখা দিয়েছে।

৮. ডায়াবেটিসের সমস্যায় উপকারী: ডায়াবেটিসে ডুমুর যেমন উপকারী, তেমনি ডুমুরের পাতাও উপকারী। ডায়াবেটিসে অনেক সময় রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, নিয়মিত ডুমুর খেলে ইনসুলিন গ্রহণের পরিমাণ কম করতে সাহায্য করে।

৯. হাড় বৃদ্ধিতে সহায়ক: ডুমুরে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে। অতিরিক্ত হাই-সল্ট ডায়েট মেনে চললে ইউরিনের মধ্য দিয়ে অনেক ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়। এই ক্যালসিয়াম লস প্রতিরোধ করতে ডুমুরের পটাশিয়াম সাহায্য করে। এভাবে ডুমুর হাড় বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়া ডুমুর হাড়ের ক্ষয়রোগও প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

১০. হার্ট ভালো রাখে: গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, ডুমুর ও ডুমুরের পাতা ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে হার্ট ভালো থাকে। এছাড়া ডুমুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাংগানিজ। যা বয়সজনিত কারণের নানা অসুখ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তাই খাদ্যতালিকায় রাখুন ডুমুর।

১১. পেটের সমস্যা দূর করে: ডুমুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যআঁশ। ফলে পেটের সমস্যার জন্য ডুমুর খুব ভালো কাজ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের সমস্যাও কমাতে সাহায্য করে।

১২. হেঁচকি: কাকডুমুর চাক চাক করে কেটে কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে আধা ঘণ্টা পর পর ১ চা-চামচ করে তা পান করলে ৪-৫ বার পান করার পরই হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়।

সাবধানতা:

ডুমুর অনেক উপকারী হলেও এটি অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে আমাদের যকৃত, পাকস্থলী এবং দাঁতের ক্ষতি হতে পারে। তাই বেশি মাত্রায় না খেয়ে অল্প করে খেলে সহজলভ্য এই ফলটি আমাদের অনেক উপকার করতে পারে। তাই আর এখন থেকে ডুমুরকে মোটেও অবহেলা করবেন না।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *