ভ্যাকসিন কূটনীতি এবং বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক

ভ্যাকসিন

ভ্যাকসিন

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদন করেছে এবং ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতাও শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন বিক্রিকে সামনে রেখে। কো-ভ্যাকসিন নামে এটিকে অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার, এই টিকাটি ভারতেই আবিষ্কৃত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য যে , ভারতের টিকা পরীক্ষা সম্পূর্ণ হবার আগেই একে ভারত সরকার অনুমোদন দিয়েছিল। আর তাতেই সংশয় প্রকাশ করেছিল ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা !

সম্প্রতি বিবিসি বাংলা প্রকাশ করেছে কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মার  মতে, কো-ভ্যাক্সিন নামে এই টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের মাধ্যমে পুরোপুরি পর্যালোচনা করে দেখা হয়নি।

এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টারস প্রকাশ করেছে যে ,ভারতীয় ওষুধ কর্তৃপক্ষ টিকাটি নিরাপদ বলে জানালেও করোনাভাইরাস ঠেকাতে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেনি। যা খোদ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতেই সংশয়ের জন্ম দিয়েছে।

ইন্ডিয়ান নেটওয়ার্ক বলেছে টিকা-র এই তাড়াহুড়ায় তারা স্থম্ভিত । প্রতিষ্ঠানটির মতে টিকার কার্যকারিতার ব্যাপারে সঠিক কোন ফলাফল না থাকায় এবং পরীক্ষায় স্বচ্ছতা না থাকায় তারাও ভিন্ন মত দিয়েছে। তাদের মতে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে এবং অনুমোদন দেবার বৈজ্ঞানিক যুক্তিও তারা বুঝতে পারছেন না ।

ভারতীয় এই টিকার উদ্ভাবক “ভারত বায়োটেক” বলেছে টিকাটি প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের ট্রায়ালে ভালো ফল পাওয়া গেছে। সরকারি কর্তৃপক্ষ নিরাপদ ও কার্যকর বলে মত দিয়েছেন । কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে যেহেতু টিকাটি ফলাফল এবং এর উপাত্তগুলো বৈজ্ঞানিকদের যাচাই করার সুযোগ হয়নি এবং তা প্রকাশ হয়নি তাই এটা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যায়। তড়িঘড়ি করে টীকা অনুমোদন দেওয়া নিয়ে ভারতেই তীব্র বিতর্ক সৃষ্ট হয়েছে এবং  টিকার অনুমোদন দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও কংগ্রেস নেতা শশী থারুর ও জয়রাম রমেশ । সূত্র: বিবিসি বাংলা।

মজার ব্যপার হচ্ছে, ইন্ডিয়ান টাইমস উল্লেখ করেছে, নরেন্দ্র মোদি সরকার এই টিকাকে “গেম চেঞ্জার” হিসেবে ঘোষণা করেছে।

আমরা জানি না ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি সাহেব কেন ভারতের এই টিকাকে গেম চেঞ্জার বলে অভিহিত করেছেন । তবে কি আমরা এটা দেখতে পাচ্ছি যে ভ্যাকসিন এখন কূটনীতির অংশ হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। যাকিনা ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিনামূল্যে করোনা ভাইরাস টিকা পাঠানোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ,নেপাল মিয়ানমারের মত দেশগুলোতে  উপহার হিসেবে এই টিকা পাঠানো হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কোন পণ্যের বাজার সৃষ্ট করার আগে একে আগে বিনামুল্য বিতরণ করা হয়। যেমনঃ বাংলাদেশের মানুষ যখন গুঁড়াদুধ কি জিনিস জানতো না, তখন এই দেশের মানুষের পুষ্টি বাড়ানোর জন্য গুঁড়াদুধ বিনামূল্য বিতরণ করা হত।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে ভারত সবচেয়ে বেশি পরিমাণ টীকা উপহার দিয়েছে যার পরিমাণ কমপক্ষে ২০ লক্ষ ডোজ । তবে ভারত কিভাবে তার এই সন্দেহপূর্ণ টিকাটি রপ্তানি করে মুনাফা আদায় করতে চাচ্ছে তা বুঝতে হলে খুব বেশি অংক করার প্রয়োজন পড়ে না।

ভারতের গেম চেঞ্জার ভ্যাকসিনটি আসলে যে চীনের তৈরি টিকা কে টক্কর দেওয়ার একটি উদ্দেশ্য তা আমরা খুব সহজভাবে অনুমেয় করতে পারছি। আসলে করোনার এই সংকট খুলে দিয়েছে ভ্যাকসিন কূটনীতি ও অর্থনীতির নতুন নতুন দুয়ার। এর গবেষণা ও উৎপাদনের সাথে জড়িত বিভিন্ন দেশ তাদের স্বার্থে অন্য দেশের সাথে তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কাজে ব্যবহার করছে।

গত বছর আমরা এটাও দেখেছি বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কে যখন টানা পোড়ান চলছে তখন এই সম্পর্ক উন্নয়ন করতে অগাস্ট মাসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশ সফরে এসে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন দেওয়ার ঘোষণা দেন। এই ধরনের প্রতিশ্রুতি ভারত প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান,  মিয়ানমার,  শ্রীলংকা এবং আফগানিস্তানকে দিয়েছে শুধু পাকিস্তান ছাড়া।

উপমহাদেশের এক সময়ের একই ছাদের নীচে গড়ে ওঠা পাকিস্তানকে ভারত সামগ্রিকভাবে এই টিকা কর্মসূচি থেকে বাদ দিয়েছে এবং গত দু’বছর মতো ভারত-এর সাথে পাকিস্তানের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। কিন্তু ভারত এখানে মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারতো। যদিও পাকিস্তানকে তার প্রতিবেশী দেশ  মহামতি চীন থাকার ফলে ভারতের উপর তেমনভাবে নির্ভর হতে হবে না। কিন্তু ভারতের সামনে এক বিশাল  সুযোগ ছিল পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নিজের ইমেজকে কিছুটা উজ্জ্বল করার।

কার্টেসি

মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছুদিন আগে এই ভারতের উপরই আমরা পেঁয়াজ আমদানির জন্য নির্ভরশীল ছিলাম এবং  ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে যখন বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছিল, পেঁয়াজের দাম হুহু করে বেড়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই  ১৫ বছর পর ভারত-বাংলাদেশ এর চিরশত্রু পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৩০০ টন পেঁয়াজ আমদানি করে ।

এই যখন অবস্থা তখন আসলে সুখের পায়রা কে? চিনতে নিশ্চয় আমাদের  অসুবিধা হওয়ার কথা না।

আমাদের প্রয়াত প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা ঠিকই বলেছিলেন,  বাংলাদেশ ফারাক্কা ন্যায্য সুবিধা আদায় করতে পারবে না । তাঁর প্রয়াণের এত বছর পরেও এই কথাটি সত্যই রয়ে গেল। সত্যিকার অর্থে, তিনিই ছিলেন এদেশের যথার্থ বুদ্ধিজীবী। আবার আমরা এদিকে তিস্তা পানির কোনো ফয়সালা না করেই ফেনীর পানি ভারতকে দিয়েছি ।

বাঙ্গালি !! আমরা এক আজব জাতি মাইরি । ব্যক্তিগতভাবে  আমার মনে হয় আহমদ ছফা থাকলে এর  প্রচন্ড বিরোধিতা করতেন।

আসলে এই সময়ে ভারতের কূটনৈতিক তৎপরতা এবং এবং কর্মধারা বিশ্লেষণ করে এটা কি বোঝা যায় না যে ভারত সব সময় তার প্রতিবেশী দেশগুলোর বিপদের বন্ধু নয়। ভারত রোহিঙ্গা ইস্যু কিংবা পেঁয়াজ সংকটের সময় হাত বাড়িয়ে সাহায্য করেনি। কিন্তু নিজের আখের গোছাতে ভারত সবসময় এক পা এগিয়ে।

কিন্তু আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা যদি নিজ দেশমুখী হতো, যেমন  সবসময় ভারতমুখী না হয়ে কিছুটা বাংলাদেশমুখি হয়ে চিন্তা করা, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক সম্বন্ধে ভারতকে সচেতন করে তোলা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহায়তা দিয়েছে তবে এই জন্য চিরকৃতজ্ঞ বাংলাদেশ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার এত বছর পরেও সব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে ছাড় দিয়েই যাবে এবং ভারত সফলভাবে তার বাজার হিসেবে বাংলাদেশকে সবসময় ব্যবহার করবে তা নিশ্চয়ই কাম্য নয় ?

আমাদের এখন চৈতন্য হওয়ার সময় হয়েছে সুখের পায়রা কে আমরা যদি এখনো না চিনি তবে আর কবে চিনবো?

রবীন্দ্রনাথের একটি চরণ মনে পড়ে, “সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসিখেলা, এ কি আর ভালো লাগে”।

বাংলাদেশ পররাষ্ট্র নীতি সব সময় ভারতবন্ধু না থেকে কিছুটা নিরপেক্ষ হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে আমার মত।

বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল এই করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার ও উৎপাদন করার ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া । সেক্ষেত্রে আমাদের বৈজ্ঞানিক এবং আমলাতান্ত্রিক পশ্চাৎপদতা থাকতে পারে কিন্তু চেষ্টা করতে কোন অসুবিধা নাই , আমাদের রয়েছে ড. বিজন কুমার শীল গবেষক এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এর মত গবেষক।

বাংলাদেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশীয় ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারত কোন পক্ষই বাংলাদেশকে হারাতে চাইবে না । তাই বাংলাদেশের সুযোগটা নেওয়া খুব জরুরি ছিল। বর্তমান সরকারের অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় একটি সুসময় অতিবাহিত করছে।

লেখক:
গবেষক, জিআইএস, জার্মানি।
Fahmidayasmin2025@gmail.com

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *