ভ্যাট বৃদ্ধিতে মানুষের ওপর চাপ বাড়বে

দেশব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করেছে নভেল করোনাভাইরাস। যার প্রকোপে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। এ ব্যাধি সংক্রমণের আশংকায় স্বাভাবিক আয়-রোজগার বন্ধ থাকায় আর্থিক অনটনে আছে অনেকে। করোনা ব্যাধি কবে শেষ হবে তা জানা নেই কারো।এমন পরিস্থিতিতেও আগামী অর্থবছরে ছাড় নেই রাজস্ব পরিশোধে।

আসছে বাজেটে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অংকের ভ্যাট (ভেলু এডেড ট্যাক্স) বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন, ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোয় সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। করোনাকালীন সংকটে থাকা বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। এতে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

নব্বইয়ের দশক থেকে এদেশে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রচলন। সরকার পণ্যের মূল্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভ্যাট যোগ করে আদায় করে থাকে। পণ্য কিনতে গিয়ে ক্রেতা নিজের অজান্তেই পণ্যের মূল্য হিসাবে ভ্যাট পরিশোধ করে থাকে। ধনী-দরিদ্র সকলকেই একই হারে ভ্যাট দিতে হয়।

প্রতিবছরই বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। বাজেটের অর্থায়নের প্রায় ৬০ ভাগ যোগাড়ের দায় পড়ে এনবিআরের কাঁধে। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে। রাজস্ব আদায়ের নিরাপদখাত হিসাবে প্রতিবছরই ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। আগামী অর্থ বছরেও রয়েছে অতীতের ধারা। করোনার কারণে আর্থিক সংকটে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাটের ভার বাড়ানো হলে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরোক্ষ করের চেয়ে করের আওতা বাড়িয়ে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন। প্রত্যক্ষ কর আদায় না হওয়ার প্রকৃত কারণগুলো পর্যালোচনা করে বাস্তবমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে প্রকৃতপক্ষেই পরোক্ষ কর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ কর নির্ভর বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।

চলতি অর্থ বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট খাতে সর্বোচ্চ এক লাখ ১৭ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আয়করখাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এক লাখ ১৫ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা ও শুল্ক খাতে ৯২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকায় চলতি অর্থ বছরের রাজস্ব আদায়ের তিনখাতেই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমানো হয়েছে।

গত অর্থ বছরে ভ্যাট খাতে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা, আয়কর ১ লাখ ২ হাজার ২০১ কোটি টাকা এবং শূল্ক ৮৪ হাজার কোটি টাকা ধার্য করা হয়। এ তিনখাত মিলিয়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। ঘাটতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, একটি বিস্কুট কিনতে একজন ধনী ব্যক্তিকে যে পরিমাণ ভ্যাট দিতে হবে একজন দরিদ্র ব্যক্তিকেও বাধ্যতামূলকভাবে একই ভ্যাট দিতে হয়। সরকার ভ্যাট নির্ধারণ করে দেয়। করোনার কারণে দেশের অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। ভয়ানক এ মরণব্যাধির কারণে সাধারণ মানুষ আর্থিক সংকটে পড়েছে। এনবিআরের ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের খরচ বাড়বে। এতে করোনার কারণে আর্থিক সংকটে থাকা মানুষদের কষ্ট বাড়বে।

এ বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফল পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা জানি পরোক্ষ করের চাপ সাধারণ মানুষের ওপরেই বেশি পড়ে। এটা আদায় করা সহজ। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে বিভিন্ন ব্যয় করতে হয়। সেই ব্যয়ের ওপর ট্যাক্স রাখা হলে সেটা আদায়ও অনেক সহজ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, আমরা কীভাবে কর ফাঁকি রোধ করতে পারি। প্রত্যক্ষ কর যেটা দেওয়ার কথা, সেটা ঠিক মতো আসছে কিনা সেটার কঠোর নজরদারি করতে পারি। এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের ওয়েলথ ট্যাক্স এবং ইনহেরিটেন্স ট্যাক্স ইন্ট্রুডিউস করার বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি।

করোনা ব্যাধির প্রকোপে অর্থনীতির অনেকখাতে মন্দা চলছে। রপ্তানি আয়ে ধ্বস নেমেছে। গত দশ মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশি ঘাটতি ৫৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি কাঁটছাট করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে থেকে কবে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে তার সময় সীমা নেই। এমন প্রেক্ষাপটেও এনবিআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তারা এনবিআরের জন্য ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে আগামী অর্থ বছরের রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ করছেন।

আগামী অর্থ বছরের জন্য আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণেও পিছিয়ে নেই এনবিআর। চলতি অর্থ বছরের তুলনায় আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর কথা শোনা যাচ্ছে। আসছে অর্থবছরে আয়করের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। আগামীতে সবচেয়ে কম লক্ষ্যমাত্রা ৯৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে শূল্কখাতে।

এনবিআরের এ হিসাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চূড়ান্ত অনুমোদনে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিলে তা বাজেট প্রস্তাবে অর্ন্তভুক্ত করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় এ হিসাব বাড়ানো বা কমানোর আইনি ক্ষমতা রাখে। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী এসব হিসাব পরিবর্তন করতে পারেন বলে জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।

সূত্র: অর্থসূচক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *