মরিচের গুণ: শুধু কাঁচা মরিচ নয়, শুকনা মরিচেও আছে উপকার

আমরা প্রায় প্রতিদিনই ডাল কিংবা সবজিতে ফোড়ন দেয়ার গন্ধ পাই। পাঁচমিশালী মসলার ফোড়ন। গরম তেলে দেয়া ফোড়নের গন্ধে মনটা ভড়ে যায় খাওয়ার আনন্দে। কিন্তু এই ফোড়নের মসলায় কি কি থাকে? তা যাই থাক, অন্যতম হলো শুকনা মরিচ। ইস্ ফোড়নের গন্ধটাই যদি খাওয়া যেতো। তবে যাই বলি, মরিচ পোড়ার একটা মাদকতা গন্ধ কিন্তু আছে যা আমাদের রসনা তৃপ্তিরই একটি অংশ। আবার মরিচের আচারও বেশ আগে থেকেই আমরা দেখে আসছি।

মরিচ এক প্রকারের ফল যা মসলা হিসাবে ঝাল স্বাদের জন্য রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Capsicum annuum. মরিচের আদি নিবাস আমেরিকা মহাদেশে। তবে বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র রান্না ও ঔষধি হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

জাত:
বাংলাদেশে বারি কিছু জাত উদ্ভাবন করেছে। তবে তা সমাদৃত হতে পারেনি। এলাকা ভেদে কোন কোন স্থানে স্থানীয় জাত আছে। এদের মধ্যে বগুড়ার বোনা, বাইন, সাইটা, ইরি, বালিজুরি ইত্যাদি বোনা মরিচের জাত রয়েছে।
রোপা মরিচের মধ্যে সূর্যমুখী, পবা স্পেসাল, সিটিন, হালদা, জারলা, শিকারপুরী, চৌরা, উবধা, বালিজুরি পাটনাই ইত্যাদি মৌসুমী রোপা মরিচের চাষ রয়েছে।

সাধারনত দু’ধরনের মরিচ আছে। যথা:
(১) কম ঝাল বা ঝালবিহীন মরিচ। এটা কেপসিকাম ফ্রুটিসেন্স ( C. frutescence ) নামে পরিচিত এবং আচার বীজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
(২) ঝাল মরিচ। এটি কেপসিকাম এনাম ( C. annum ) নামে পরিচিত এবং প্রধানত মসলা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কেপসাইসিন ( Capsaicin ) নামক রাসায়নিক পদার্থের জন্য মরিচ ঝাল হয় ও কেপসানথিন ( Capsanthin ) নামক একটি রঞ্জক পদার্থের ( Pigment ) জন্যে মরিচ উজ্জল লাল হয়। মরিচে ভিটামিন-এ ও সি থাকে বেশি পরিমাণে।

জলবায়ু:
উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় মরিচ ভাল হয়। ফল পাকার সময় শুকনো আবহাওয়া দরকার। মাটির তাপমাত্রা ৬৫-৮৫ ফারেনহাইট (১৮.৩-২৯.৪ সেলসিয়াস) থাকলে বীজের অঙ্কুরোদগম ভাল হয়। অধিক সূর্যালোকে ফলন বাড়লেও এর ঝাল ও রঙ কমে যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি মরিচের পক্ষে ক্ষতিকর। ফুল ফোটা ও ফসল ধরবার সময় বেশি বৃষ্টি হলে অসময়ে ফুল ও ফল ঝরে যায়।

মাটি:
প্রায় সব রকম মাটিতেই মরিচ জন্মে। তবে দোআঁশ, বেলে-দোআঁশ মাটিতে এর চাষ ভাল হয়। জলাবদ্ধ অবস্থা মরিচ মোটেই সহ্য করতে পারে না।

কাঁচা মরিচ এর গুনাগুণ:
কাঁচা মরিচে থাকা ডায়াটারি ফাইবার, সোডিয়াম, থিয়ামিন, রাইবোফ্লবিন, নিয়াসিন, ফলেট, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন এ, সি, কে, বি৬, পটাসিয়াম, কপার এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো উপাদান নানাভাবে শরীরের উপকারে লাগে থাকে।

১। গরম কালে কাঁচা মরিচ খেলে ঘামের মাধ্যমে শরীর ঠান্ডা থাকে। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকে। কাঁচা মরিচের স্বাদ ঝাল হওয়ার কারণ এর মধ্যে ক্যাপসিসিন নামক এক প্রকার উপাদান থাকায়। এই উপাদানটি স্বাদ গ্রন্থিকে অ্যাকটিভ করে তোলার পাশাপাশি মস্তিষ্কের হাইপোথেলামাস অংশকে অতি মাত্রায় সচল করে তোলে। ফলে শরীরের তাপমাত্রা এতটা কমে যায় যে গরমের খারাপ প্রভাব দেহের উপর পরার আশঙ্কা একেবারেই থাকে না।
২। প্রতিদিন একটি করে কাঁচা মরিচ খেলে শরীরে রক্ত জমাট বাধার ঝুঁকি কমে যায়।
৩। নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেলে হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন সমস্যা কমে যায়। কাঁচা মরিচে থাকা একাধিক উপকারী উপাদান রক্তে উপস্থিত খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে ফেলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে হার্টের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা একেবারে কমে যায়। সেই সঙ্গে ফাইব্রিনোলেটিক অ্যাকটিভিটিকে বাড়িয়ে দিয়ে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধতে দেয় না। ফলে স্ট্রোকের আশঙ্কা একেবারে কমে যায়।
৪। কাঁচা মরিচ মেটাবলিসম বাড়িয়ে ক্যালোরি পোড়াতে সহায়তা করে।
৫। কাঁচা মরিচে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিটা ক্যারোটিন আছে যা কার্ডোভাস্ক্যুলার সিস্টেম কে কর্মক্ষম রাখে। পাশাপাশি জ্বর, সর্দি-কাশি ইত্যাদি থেকে বাঁচায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
৬। নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
৭। কাঁচা মরিচ রক্তের কোলেস্টেরল কমায়।
৮। কাঁচা মরিচে আছে ভিটামিন এ’ যা হাড়, দাঁত ও মিউকাস মেমব্রেনকে ভালো রাখতে সহায়তা করে।
৯। কাঁচা মরিচে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ভিটামিন সি এবং বিটা-ক্যারোটিন। এই দুটি উপাদান শরীরে প্রবেশ করার পর এমন খেল দেখায় যে বলিরেখা গায়েব হতে শুরু করে। ফলে ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে চুলের স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটে। এই দুটি উপাদান দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটাতেও সাহায্য করে।
১০। নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেলে নার্ভের বিভিন্ন সমস্যা কমে।
১১। হজমে মহৌষধের মতো কাজ করে কাঁচা মরিচ। এটি খেলে শরীরে ভিটামিন সি-এর মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি স্যালাইভার উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। ফলে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে। বদহজমের মতো সমস্যা দূরে পালায় চোখের পলকে।
১২। প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় কাঁচা মরিচ।
১৩। কাঁচা মরিচ খেলে মস্তিষ্কে সুখী হরমোন এনডরফিন নিঃসৃত হয়। এতে মন-মেজাজ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
১৪। কাঁচা মরিচ খেলে সাইনাসের মতো রোগ দূরে পালায়। মরিচে থাকা ক্যাপসিসিন মিউকাস মেমব্রেনের অভ্যন্তরে রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ঠাণ্ডা লাগার কারণে হওয়া নানাবিধ শারীরিক সমস্যা যেমন কমে যায়, তেমনি সাইনাস ইনফেকশনের কষ্ট কমতেও সময় লাগে না।
১৫। নিয়মিত কাঁচা মরিচ খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। প্রতিদিন কাঁচা মরিচ খেলে হজম ক্ষমতা এত মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা একেবারে কমে যায়। সেই সঙ্গে শরীরে জমে থাকা ফ্যাট সেলেরা এত মাত্রায় গলতে শুরু করে যে ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে একেবারেই সময় লাগে না।
১৬। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে মরিচ। নিয়মিত কাঁচা মরিচ খাওয়া শুরু করলে ইনসুলিনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সুযোগই পায় না। ফলে ডায়াবেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যায় কমে।
১৭। কাঁচা মরিচে থাকা একাধিক উপকারি উপাদান দেহে প্রবেশ করার পরে যে কোনও ধরনের যন্ত্রণা কমতে সময়ই লাগে না।

শুকনা মরিচ-এর গুনাগুণ:
শুকনা মরিচ ও কাঁচা মরিচের কার্যকারিতা প্রায় এক হলেও কাঁচা মরিচ ও শুকনা মরিচ এর গুনাগুনের কিছু তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। শুকনা মরিচে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ”এ” ও ”সি” থাকে। তাই নিয়মিত এই মরিচ খেলে শরীরে ভিটামিন-সি এর অভাব দূর করে।

১। হজম শক্তি বৃদ্ধি করে: শুকনো মরিচ হজম শক্তি বাড়ায়। আঁশ জাতীয় খাবার হওয়ার কারণে হজম ত্বরান্বিত হয়।
২। ব্যথা কমায়: গিটে গিটে ব্যথা কমায়, শুকনা মরিচে থাকা ভিটামিন-ই ব্যাথা কমানোর কাজ করে।
৩। ক্যান্সার রোধ করে: লাল মরিচে থাকা ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস কোলন ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার রোধে কাজ করে।
৪। দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে: লাল মরিচে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন-এ থাকায় এটি দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করতেও কাজ করে।
৫। ক্ষুধা নিবারন করে: লাল মরিচের ক্যাপসাইসিন উপাদানটি আপনার ক্ষুধা কমিয়ে আনবে। সবসময় পেট ভরা অনুভূতি কাজ করবে।
৭। উচ্চরক্ত চাপ কমায়: উচ্চরক্ত চাপ কমাতেও একটি ভালো ভূমিকা পালন করবে এই মরিচ। এর অন্যতম উপাদান আঁশ যা রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে।
৮। ভিটামিনের অভাব দূর করে: টক টকে লাল শুকনা মরিচে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ”এ” ও ”সি” উপস্থিত। তাই শরীরে ভিটামিন ”এ” ও ”সি”-এর অভাব থাকলে নিয়মিত খেতে পারেন।
৯। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে: শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করতে শুকনা মরিচ খুব কার্যকরী ভূমিকা রাখে এবং বাতের ব্যথাও রোধ করতে সক্ষম শুকনা লাল মরিচ।
১০। সর্দি-কাশিতে সাহায্য করে: সর্দি হলেও শুকনা মরিচ খাওয়ার পরামর্শ দেন অনেকেই। কেননা এতে নাক বন্ধ থাকলে উপকার পাওয়া যায়।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *