শিশুর নৈতিক শিক্ষা ও আমাদের করণীয়

একজন মানব শিশু তখনই মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে যখন সে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নৈতিক শিক্ষা লাভ করে এবং শিশুকালই হলো একজন মানব শিশুকে নৈতিকতা আর মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ বয়সে শিশু যে শিক্ষাটি পেয়ে থাকে সেটি তার সারাজীবনে পথ চলার পাথেয় হয়ে থাকে। নৈতিক শিক্ষা গ্রহণে মানব মনে মূল্যবোধ জাগ্রত হয়, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গে ভেদাভেদ না করে মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, মানুষকে সম্মান করতে শেখায়, মানুষের মতামতকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। আর এভাবেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ একজন মানুষের সারাজীবনের পথ চলার সাথী হয়ে থাকে। তখন তিনি হয়ে যান স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তি।

একজন মানব শিশুর নৈতিক শিক্ষার আবশ্যিকতা

১. শিশুরাই আগামি দিনের পথ প্রদর্শক। তারাই একদিন বাবা-মা হবে, দেশের কর্ণধার হবে। এজন্যই তাদের নৈতিক শিক্ষা দেয়া আবশ্যক।

২. একজন মানব শিশু নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে ভালো, মন্দ, ন্যায়, অন্যায় চিহ্নিত করতে পারে। সময়ের প্রয়োজনে না বলতেও শিখে।

৩. নৈতিক শিক্ষা গ্রহণে জীবন চলার পথে নানা প্রশ্ন ও কৌতুহলের উত্তর নিজে নিজেই তৈরি করতে ও দিতে পারে নিজেকে। এতে তার ভবিষ্যত হয় উজ্জ্বল।

৪. নৈতিক শিক্ষা একজন মানব শিশুকে আত্মবিশ্বাসী হতে ধাবিত করে।

নৈতিক শিক্ষার ভাবনাগুলো;

দায়িত্ববোধ:

শিশুকে তার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। তার নিজের কাজ নিজেকে করতে অনুপ্রেরণা দিতে হবে। নিজের খেলনা নিজেকে গুছিয়ে রাখতে, নিজের দাঁত নিজে ব্রাশ করতে, ছোট ভাই-বোনের খেয়াল রাখতে দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। পাশাপাশি বড়রা শিশুদের কাছে নিজেদের দায়িত্ববান হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। অর্থাৎ শিশুকে যা যা বলা হয়েছে বা যেভাবে দেখতে চাই তা নিজের মধ্যে অনুশীলন করা।

সততা:

দেখা যায় এই বয়সে শিশুরা খুব দ্রুত মিথ্যা কথা বলতে শিখে যায় পারিপার্শ্বিকতার জন্য। বকা খাওয়া বা মারধোরের হাত থেকে বাঁচতে কোন অপরাধ করলেও মিথ্যা কথা বলে বসে খুব সহজেই। এই সব ছোট ছোট মিথ্যা বলতে বলতে এক সময় মিথ্যা কথা বলা স্বভাবে পরিণত হতে থাকে। এই জন্যে শিশু বয়সেই সত্য কথা বলার অভ্যাস করাতে হবে। শিশু কোন অন্যায় বা ভুল করলে কথায় কথায় বকা না দেয়া বা তার গায়ে হাত তোলা যাবে না। এতে সে বাঁচার জন্য মিথ্যা বলবে। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যে সে যা করেছে তা ভুল করেছে। এবং এমন ভুল যেন সে আগামিতে না করে। বাড়ীর বড়রা কখনো শিশুর সামনে মিথ্যা কথা বলবেন না বা কোন চাতুরীর আশ্রয় নিবেন না। অনেক সময় দেখা যায় রাজনৈতিক নেতারা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের জ্ঞাতসারেই জনপ্রিয়তা দেখানোর জন্য ভাড়াটিয়া লোক দিয়ে শোডাউন করেন। এমন গর্হিত কাজ থেকে সর্বদা নিজেকে বিরত রাখা। সততার সাথে জীবন অতিবাহিত করা।

ন্যায় বিচার:

প্রতিটা শিশুকেই ভালো বা মন্দ, ন্যায় বা অন্যায়, নীতি বা আদর্শ এ বয়সেই বুঝিয়ে বলতে হবে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে সমাজের কলুষিত রূপগুলো। পাশাপাশি বড়দেরও একই আদর্শ পালন করতে হবে আয়নার মতো। কথা ও কাজে নীতিবান থাকতে হবে শততে শতভাগ।

সম্মান:

মানুষ মানুষকে সম্মান করবে এ শিক্ষা দিতে হবে। মানুষকে হেয় করে কথা বলবে না। প্রতিজন মানুষের কাজের মূল্যায়ণ করতে শিক্ষা দিতে হবে। বাসা কিংবা রাস্তায় কাজের লোকটিকে সম্মান করতে শেখাতে হবে। বড়রা শিশুর সামনে কখনোই কাউকে অসম্মান করে কথা বলবে না। প্রয়োজনে শিশুদের আড়ালে কোন অপরাধীকে বুঝিয়ে বলে সমাধানে আসতে হবে।

নম্রতা:

নম্রতা জীবন চলার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাকে হালকা করে দেখার কিছু নেই। খেয়াল রাখতে হবে আপনার শিশু যেন খুব অল্পতেই রেগে না যায়। ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দিতে হবে। আবার একই ভাবে কোন সাফল্য পেলে যেন অহংকার না করে সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। তাকে নম্র হতে শিক্ষা দিতে হবে। দুঃখী মানুষের কষ্টে তার পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি বড়রাও একই আচরণ করবে ও চলবে।

ধৈর্য:

জীবনে সাফল্য পেতে গেলে ধৈর্য ধারণ করতেই হবে। এর বিকল্প কিছু হতে পারে না। শিশুটির মাঝে ধৈর্য ধারণ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কোন কাজে সাফল্য না আসলে হতাশ হতে বারণ করতে হবে। ধৈর্য ধরে আবার একই কাজের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে বলতে হবে। পাশাপাশি বড়রাও একইভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

ভালোবাসা:

শুধু নিজ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে বড়দের। ধনী-গরীব,  পশু-পাখি, গাছপালা সবাইকে ভালবাসতে শিখাতে হবে আপন শিশুকে। পাশাপাশি সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে ভালবাসতে শিখাতে হবে এবং নিজেও ভালেবাসতে হবে। বাস্তবে অভাবী মানুষকে সহায়তা করতে হবে আপনার মতো করে। আপনার শিশুকে আপনিই ভালোবাসুন, প্রতিদান পাবেন।

আর এভাবেই শিশুর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠে তা খেয়াল রাখুন। ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন আপনার চারিপাশে। আপনার কাছে থেকেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হোক পৃথিবীর প্রতিটা শিশুর অন্তরে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *