সুগন্ধ ও ঔষধি গুণে ভরপুর লেমন গ্রাস !

লেমন গ্রাস (বৈজ্ঞানিক নাম: Cymbopogon sp., Family: Poaceae বা Graminae) সাধারণভাবে থাই পাতা নামে পরিচিত। কারণ, এর পাতা থাই স্যুপ রান্নায় অধিকাংশ সময়ই ব্যবহার করা হয়। এটি ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ এর বৃদ্ধিও অনেকটা ঘাসের মতো হয়। এটি শুধু থাই স্যুপে নয়, যে কোনো থাই বা অন্য কোনো সৌখিন রেসিপিতেও ব্যবহৃত হয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে বৈকি।

লেমন গ্রাস একটি সুগন্ধিযুক্ত বিরুৎ (ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ) গাছ যা বৃহত্তর এশিয়া ও আফ্রিকায় চা, স্যুপ ও বিভিন্ন তরকারিতে একটি উপাদেয় উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটা শুকনো, গুঁড়া অথবা তাজা অবস্থায় ব্যবহার করা যায়। এটির তেল কীটনাশক ও খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহার করা হয়। খাদ্যনালির পেটব্যথা, উচ্চ রক্তচাপ, বমি, কফ, বাত, জ্বর, ঠান্ডা ও অস্থিরতার উপশমে এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি মাথাব্যথা, পেটব্যথা ও মাংসপেশির ব্যথায় সরাসরি চামড়ায় ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া সুগন্ধি হিসেবে সাবান ও প্রসাধনীতেও ব্যবহার হয়ে থাকে প্রাকৃতিক উপাদান হিসাবে।

লেমন গ্রাসের প্রাকৃতিক রাসায়নিক উপাদানগুলোর মধ্যে মূলত রয়েছে টারপিনস, অ্যালকোহল, কিটোন এলডিহাইড এবং এস্টার। এ ছাড়া এতে রয়েছে অ্যাসেনসিয়াল অয়েল আলফা সাইট্রাল, বিটা সাইট্রাল, নিরোল জেরানিওল, সাইট্রোনিলাল, টারপিনোলিন, জেরানাইল এসিটেড, মাইরিসিন এবং টারপিনল মিথাইল হেপটিনোন। আরো রয়েছে ফ্লেভোনয়েডস ও লিউটিওলিন আইসোওরিয়েনটিন ২-অর্থো র‌্যামনোসাইড, কোয়েরসেটিন, কেমফিরন, এপিজিনিন জাতীয় ফেনোলিক এসিড।

জীবাণুনাশক হিসেবে এটি ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বংশ বৃদ্ধিকে রোধ করে। ক্লোরকুইনজাতীয় এন্টিবায়োটিকের মতো লেমন গ্রাস অয়েল ম্যালেরিয়া জীবাণু, ক্ষতিকর প্রোটোজোয়া, মাকড়ের বিরুদ্ধে এটি কাজ করে।

গুনাগুণসমূহ-

হজমশক্তি বাড়ায়: লেমন গ্রাস পেট পরিষ্কার রাখে এবং হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এর মধ্যে সাইট্রাল নামক এক প্রকার উপাদান আছে যা হজম শক্তিতে সহায়তা করে। এটি বদহজম, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠ্যকাঠিন্য ইত্যাদি যাবতীয় পেটের রোগের উপশমে ভালো কাজ করে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে: লেমন গ্রাস একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে উপযোগী। এটি পটাশিয়াম সমৃদ্ধ যা শরীরে প্রস্রাব এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে রক্ত সঞ্চালনকে উত্তেজিত করে রক্ত চাপ কমায়। এটি লিভারকে শুদ্ধ করতে সহায়তা করে। এটি হৃদরোগ সংক্রান্ত সমস্যা কমাতে উপকারী ভূমিকা পালন করে।

ওজন হ্রাস করতে সহায়ক: লেমন গ্রাস ওজন হ্রাসে সহায়ক। এটি বিপাক প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে, যা হজমে সহায়ক হয়। এটি শরীরের ক্যালরি হ্রাস করতে সাহায্য করে।

ত্বক ও চুলের পক্ষে উপকারী: লেমন গ্রাস ভিটামিন এ’ ও ভিটামিন সি’ তে পরিপূর্ণ, যা ত্বক ও চুলের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নিউট্রিয়েন্ট। এটি রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে ত্বককে পরিষ্কার রাখে।

অ্যানিমিয়া দূর করে: রক্তে লোহিত কণিকা বা হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণে দেখা দেয় অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা। এতে ফলিক এসিড, তামা, থায়ামিন, লৌহ, দস্তা ইত্যাদি উপস্থিত থাকায় তা লোহিত কণিকা বাড়াতে সহায়তা করে।

সর্দি, কাশি ও জ্বরে উপকারী: এটি প্রাচীনকাল থেকেই সর্দি, কাশি ইত্যাদি রোগের নিরাময় রূপে আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি ফাঙ্গাল গুণে সমৃদ্ধ, যা সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদি মোকাবিলায় সাহায্য করে এবং এতে উপস্থিত ভিটামিন সি’ ইমিউনিটি শক্তি বাড়ায়। লেমন গ্রাস, তুলসী পাতা ও এলাচের গরম মিশ্রণ সর্দি কাশির নিরাময়ে দারুন কাজ করে।

কার্যকারী ডিটক্সিফায়ার: লেমন গ্রাসের শোধন বৈশিষ্ট্য, শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয়। লেমন গ্রাস একাধারে লিভার, অগ্ন্যাশয়, কিডনি এবং মুত্রথলি পরিষ্কার করার পাশাপাশি সার্বিকভাবে রক্ত চলাচল বাড়ায়। প্রতিদিন লেমন গ্রাস চা খেলে সেটা রক্তস্রোত থেকে সব ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান বের করে দিয়ে শরীরকে ডিটক্সিফাই করে।

আর্থারাইটিসের ব্যথা নিরাময় করে: লেমন গ্রাসের মধ্যে অ্যান্টি-ইনফ্লামেটারি এবং ব্যথা নিরাময়কারী গুণ ভরপুর থাকার ফলে এটা আর্থারাইটিস, রিউমাটিজম, গাউট এবং গাঁটের অন্যান্য ব্যথা-যন্ত্রণার নিরাময় করে। লেমন গ্রাস পেশীকে শিথিল করে এবং সেই কারণে খিঁচুনি এবং মচকানির দ্রুত নিরাময় হয়। দিনে দু’বার লেমন গ্রাস চা খেলে, আর্থারাইটিসের ব্যথার হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। লেমন গ্রাস তেল দিয়ে মালিশ করলেও উপকার পাওয়া সম্ভব। নারিকেল তেলের সাথে লেমন গ্রাস তেল মিশিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।

কোলেস্টেরল ও রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করে: লেমন গ্রাসের নির্যাস মানবদেহে কোলেস্টেরল ও রক্তের গ্লুকোজ মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং সিডেটিভ হিসেবে কাজ করে সুস্থ থাকতে সহায়তা করে।

ক্যান্সারের প্রতিষেধক হিসেবে: গবেষণায় দেখা গেছে, এক কাপ লেমন গ্রাস চা-তে যে পরিমাণ সাইট্রালজাতীয় কেমিক্যাল থাকে তা ক্যান্সার কোষে আত্মঘাতী বিক্রিয়া ঘটায় এবং এতে স্বাভাবিক কোষগুলো অক্ষত থেকে যায়। এ ছাড়াও লিপিড অক্সিডেশনে ফ্রি-রেডিক্যালের মাত্রা কমানোর কাজে লেমন গ্রাস কার্যকর ভূমিকা রাখে।

এছাড়াও এতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট গুনাগুণ।

যেভাবে লেমন গ্রাস খাওয়া যেতে পারে-

– সবচেয়ে ভালো হয় স্যুপ রান্নার সময় এক ইঞ্চি পরিমাণ করে কেটে দিয়ে দিন।
– লেমন গ্রাস আপনি খেতে পারেন চায়ের সাথে মিশিয়ে। সঙ্গে খানিকটা আদা দিলে স্বাদটা আরো ভালো হবে
– এটি দিয়ে বানাতে পারেন দারুণ ঔষধি এক পানীয়। কয়েকটি লেমন গ্রাস, কয়েক কোয়া রসুন, ছোট এক টুকরো দারুচিনি, এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে নিন দুধের সাথে। এটি ভালোভাবে সেদ্ধ করে ছেঁকে পান করুন। ঠান্ডাজাতীয় সমস্যায় তাৎক্ষণিক কাজে দেবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *