স্বপ্নবাজ অদিতি: এক অদম্য নারী ফুটবলার

স্বপ্নবাজ মানুষদের কেউ জীবনে ব্যর্থ হয়েছে তার কোনো নজির নেই। প্রত্যেকেই উন্নতির শীর্ষে পৌঁছতে পেরেছেন। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে কিছু স্বপ্নবাজ নারী পেয়েছেন তাদের কাঙ্খিত পথের দিশা। তাদেরই একজন গাইবান্ধার ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ বসুন্ধরা কিংস নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ মাহমুদা শরীফা অদিতি।

অদিতির জন্ম ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল গাইবান্ধা পৌর শহরের পলাশপাড়ায়। বাবা হাসান আলী সরকার, মা এলিজা বেগম। মা-বাবার এক ছেলে, চার মেয়ের মধ্যে অদিতি চতুর্থ। প্রাথমিক স্কুলের আঙিনা থেকেই খেলাধুলার সঙ্গে সখ্যতা তার। সহপাঠী ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে স্কুল কিংবা পাড়ার মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন। ছেলেবেলায় খেলা নিয়ে মেতে থাকলেও তখন কোনো আপত্তি করেনি তার পরিবার। কিন্তু মাধ্যমিকের বড়বেলায় এসে মেয়ের খেলাধুলা নিয়ে পরিবার ঠিকই আপত্তি তুলেছিল। এতে সুর মিলিয়েছিল পাড়া-পড়শিরাও। কিন্তু তিনি ঠিকই ছেলে সেজে লুকিয়ে খেলতে চলে যেতেন। বিভিন্ন খেলার মাঠে ঢু মেরে বাবা মেয়েকে নিয়ে আসতেন বাড়িতে। শেষমেষ মেয়ের দুরন্তপনা আর অদম্য আগ্রহের কাছে হার মেনে মা-বাবা তার ফুটবল খেলার ব্যাপারে সায় দেন।

ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘটের চর-দ্বীপচর, আদিগন্ত ফসলের মাঠ কিছুই তাকে টানত না। গাইবান্ধার মেয়ে অদিতির মন সারাক্ষণ পড়ে থাকত ফুটবল মাঠে। অদিতি খেলেছেন মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলে। মেয়েদের ফুটবল লিগে মোহামেডানের হয়ে এক ম্যাচে ছয়টি গোল করার কৃতিত্বও আছে তার। এক ম্যাচে ছয়টি গোলের রেকর্ড অনেকে পেরিয়ে গেলেও প্রথমবার এই অচেনা পথে হেঁটেছিলেন অদিতিই। পাশাপাশি পড়াশোনাতেও যথেষ্ট সাফল্য আছে তার। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় অনার্স-মাস্টার্স করেন তিনি। এ ছাড়া ২০১২ সালে বিপি.এড, ২০১৫ সালে এমপি.এড সম্পন্ন করেন।

জাতীয় দলের সাবেক এই নারী ফুটবলার ২০০০-২০১২ সালে হ্যান্ডবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টনে গাইবান্ধা জেলা দলে মেয়েদের অধিনায়ক ও অ্যাথলেট হিসেবে জেলা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এ ছাড়াও ২০০৫-২০১২ সালে জাতীয় হ্যান্ডবল ও কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে অংশ নিয়েছিলেন। তবে ফুটবলটাই ছিল শরীফা অদিতির ধ্যানজ্ঞান।

গাইবান্ধায় বসে যে স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন, তা আজ শেকড়-বাকড় আর ডাল-পালা অনেকটাই বেড়েছে। স্বপ্ন ছিল বড় দলের কোচ হওয়ার। সেই পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন মাহমুদা শরীফা অদিতি। ২০০৫ সাল থেকে পুরোদস্তর ফুটবল শুরু অদিতির। বাফুফের সেকেন্ড ক্লাস রেফারি হিসেবে মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি। ২০০৮ সালে ইন্দো-বাংলা গেমসে অংশ নিয়ে প্রমিলা ফুটবলে স্বর্ণ জয় করেন। ২০০৮-২০১২ সালে আনসার-ভিডিপির হয়ে খেলেছেন জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ। ২০১১-১২ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেছেন লিগে। ২০১৩ সালে আরামবাগ নারী ফুটবল দলের সহকারী কোচ হিসেবে ছিলেন ডাগআউটে। ওই বছরই এএফসি সি-কোচিং লাইসেন্স কোর্স করে সনদ পান। ২০১৯ সালে এএফসি বি-লাইসেন্স কোর্স করে এখন বসুন্ধরা কিংসের নারী দলের প্রধান কোচ। পাশাপাশি তিনি শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষকতা করছেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে।

শরীফা অদিতি বলেন, ‘বসুন্ধরা কিংসের প্রধান কোচের দায়িত্ব আমার জীবনে একটা বড় পাওয়া। লাইসেন্স পাওয়ার পর কোচ হিসেবে এটাই আমার প্রথম ক্লাব। ভীষণ ভালো লাগছে।’ ছয় বছর দাপটের সঙ্গে নারী ফুটবল দলের স্ট্রাইকারের দায়িত্ব পালন করা অদিতি বলেন, নারী ফুটবলের প্রসারে আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি, নিয়মিত লিগ আয়োজন এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করে তৃণমূলের অনেক মেয়েকে ভালো ফুটবলার বানানো যায়। গাইবান্ধায় নারী ফুটবলার তৈরিতে বেশ কয়েকটি স্কুল টিমের মেয়েদের স্বেচ্ছাসেবী কোচ হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।

উত্তরের জেলা গাইবান্ধার ক্রীড়াঙ্গনে অনেক সীমাবদ্ধতা, বাধা-বিপত্তি আর চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বপ্নবাজ নারী মাহমুদা শরীফা অদিতি তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন। ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন বিশ্বজয় করবে, বিশ্বকাপ জয়ী মেয়েদের কোচ হিসেবে বাংলাদেশের পতাকা বুকে ধরে উচ্ছাসে মাতবেন তিনি। সেই স্বপ্ন নিয়েই মাহমুদা শরীফা অদিতির নিরন্তর স্বপ্নযাত্রা।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *