হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠতে পারে যেসব কারণে

মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার নেপথ্যে থাকতে পারে বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যা। তাই অবহেলা না করে শুরুতেই সাবধান হোন। জেনে নিন ঠিক কোন পথে চিকিৎসা করাবেন। পরামর্শে বেলভিউ হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ফিজিশিয়ান ডা. সমরজিৎ নস্কর এবং ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস কলকাতার কনসালটেন্ট নিউরোলজিস্ট ডা. আশিস দত্ত।
আমাদের সচেতনতার সম্পূর্ণ দায় বর্তায় মস্তিষ্কের ওপর। আর মস্তিষ্কের সঠিকভাবে নিজের কাজকর্ম করে চলার জন্য রক্তের দরকার পড়ে। গ্লুকোজ এবং অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত মস্তিষ্কে পৌঁছে কোষের পুষ্টি জোগায়। আর সেই পুষ্টি থেকে শক্তি সঞ্চয় করে মস্তিষ্ক কাজ করে চলে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কোনও কারণে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল সামান্য ব্যাহত হলে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার সমস্যা হয়। নির্দিষ্ট করে বললে, মস্তিষ্কের ভার্টিগো ভেসিলারি ধমনিতে রক্ত কম পৌঁছালেই মাথা ঘোরে। চিকিৎসা পরিভাষায় এর নাম সিনকোপি।
মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া একটি লক্ষণমাত্র। এটা কোনও রোগ নয়। শরীরে নানা জটিলতার কারণে এমন হয়—
হৃদপিণ্ডজনিত কারণ—আমাদের শরীরের প্রতিটি প্রান্তে রক্তকে পৌঁছে দেওয়ার গুরু দায়িত্ব থাকে হার্টের ওপর। তবে হৃৎপিণ্ডের কোনও সমস্যা হলে হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। হার্টের এহেন সমস্যার পিছনে থাকতে পারে অ্যারিদমিয়া (হৃদপিণ্ডের গতির ছন্দপতন), ব্র্যাডি কার্ডিয়া (হৃদগতি কমে যাওয়া), আর্টারি ব্লকেজ (হার্টের ধমনিতে প্লাক জমে এই সমস্যা হয়। ধমনিতে রক্তের গতিপথে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ জমে তৈরি হয় প্লাক। বাধা পায় রক্তের স্বাভাবিক চলাচল), কার্ডিও মায়োপ্যাথি (ভাইরাল ইনফেকশনের জন্য হার্টের পেশিগুলি রক্ত পাম্প করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে), পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন (হার্টে তরল জমে), হার্ট ফেলিওর, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি।
এপিলেপসি বা মৃর্গী—এটি মস্তিষ্কের স্নায়ু গঠিত একটি সমস্যা।
নিম্ন রক্তচাপ— কোনও কারণে রক্তচাপ ১২০/৮০ এমএম/এইচজি-এর নিচে চলে গেলে মস্তিষ্কে সঠিক পরিমাণে রক্ত পৌঁছাতে পারে না। এক্ষেত্রেও এই সমস্যা হতে পারে  মস্তিষ্কে টিউমার—টিউমার থেকেও মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে
চোখের প্রেশার—চোখের অন্দরে রক্তের স্বাভাবিক চাপ হল ১৮ মিলিলিটার অব মার্কারি। তবে কোনও কারণে চোখের ভিতরে রক্তের প্রেশার কমে গেলে হঠাৎ মাথা ঘোরে  কানের সমস্যা— কানের অন্দরে থাকা দেহের ভারসাম্য রক্ষাকারী স্নায়ুতে সমস্যা হলেও মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে
স্ট্রোক—ইসকেমিক স্ট্রোক এবং হেমারেজিক স্ট্রোক, এই দু’ধরনের স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেই মানুষ সাধারণত মাথা ঘুরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন রক্তক্ষরণ—দুর্ঘটনা বা অন্যান্য অনেক কারণেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্ত বেরিয়ে গিয়ে মস্তিষ্কে স্বাভাবিক পরিমাণ রক্ত পৌঁছাতে পারে না। ফলে মাথা ঘুরে পড়ে যান অনেকে রেনাল ডিজঅর্ডার—কিডনির সমস্যায় রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে হার্টের গতি কমে গিয়ে (ব্র্যাডি কার্ডিয়া) মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সুগার ফল—ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে হঠাৎ করে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন  আবেগ—অত্যধিক দুঃশ্চিন্তা (অ্যাংজাইটি), উত্তেজনা, শোক ইত্যাদির কারণেও এমন সমস্যা হতে পারে
পশ্চারাল সিনকোপি— দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যও রক্তচলাচলে ব্যাঘাত ঘটে ও মাথা ঘোরার সমস্যা হয়
 এছাড়াও রক্ত দেওয়ার সময় চোখের সামনে রক্ত দেখে (ভেসোফেজাল অ্যাটাক), কাশতে কাশতে, দুর্বলতা, মূত্রত্যাগের সময়, অত্যধিক ভিড়ের চাপে, রক্ত পায়খানা (ব্লাডি ডায়ারিয়া) এবং বিভিন্ন ওষুধের কারণেও (আলফা ব্লকার ইত্যাদি) হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সমস্যার লক্ষণ আগে থেকেই প্রকাশ পায়। মাথা ঘোরার আগে—দুর্বলতা, বমিবমি ভাব, চোখের মণি ঘোরা, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া বা অন্ধকার দেখা (ব্ল্যাক আউট), ঘন ঘন হাই ওঠা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ থাকা সম্ভব। তাই এমন লক্ষণ দেখা দিলেই বসে পড়া বা শুয়ে পড়া ভালো। পারলে পা দুটো বালিশের উপরে চাপিয়ে উঁচু করে তুলে রাখুন।
 প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার পরবর্তী পর্যায় হল সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া। রোগের চরিত্র এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে অজ্ঞান হওয়ার সময়। রোগের তীব্রতা যত বেশি, অজ্ঞান হয়ে থাকার সময়কালও থাকে তত বেশি।
কেন মাথা ঘুরছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা খুবই জরুরি। তাই রোগীকে চিকিৎসক ইসিজি, ইইজি, হল্টার মনিটরিং, মাথার সিটি স্ক্যান ইত্যাদি টেস্টগুলি করাতে দিতে পারেন। পাশাপাশি রোগীর পূর্ববর্তী রোগের ইতিহাস সম্বন্ধে জেনে সমস্যা সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরি করেন চিকিৎসক। রোগ নির্ণয় পর্ব শেষ হলে রোগ ধরে চিকিৎসা চালালেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
সচেতন হন—
জীবনযাত্রা পাল্টান। খাবারে বেশি নুন, মশলা, তেল যুক্ত খাবার, জাঙ্ক ফুড খাওয়া চলবে না। অতিরিক্ত ভাত খাওয়া এড়িয়ে চলুন। বদলে খান মরশুমি শাক, সবজি, ফল  নিয়মিত ব্যায়াম করুন।  সিগারেট, মদ্যপান বাদ দিন  রাত জাগা চলবে না। ৭ ঘণ্টা ঘুমোন। ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেশার, হার্টের অসুখ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলুন।
সমস্যা দেখা দিলে, প্রথমবারেই চিকিৎসকের কাছে যান।
স্নায়ুর রোগেও মাথা ঘোরে
 নার্ভের যে কোনও সমস্যা থেকে মাথা ঘুরতে পারে।
মৃগী রোগীর হঠাৎ কোনও উত্তেজনা বা অ্যাটাক থেকে মাথা ঘুরে যেতে পারে।
কানের পিছনে ‘ভেস্টিবুলার নার্ভ’ শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখে। কোনও কারণে সেই ব্যালেন্স নষ্ট হলে মাথা ঘোরে  কানে মেনিয়ার’স রোগ হলেও এমন উপসর্গ দেখা যায়। কানের ভিতরের ফ্লুইড কমে গিয়ে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হয়। তার থেকে কানে কম শোনা, বমি ভাব থাকে। মাথা ঘুরে যায়
কোনও কোনও রোগী ‘বিপিপিভি’ আক্রান্ত হতে পারেন। চিকিত্সা বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে বিনাইন প্যারাক্সিম্যাল পজিশনাল ভার্টিগো। এক্ষেত্রে বন বন করে মাথা ঘোরে। বিছানা থেকে নামতে, উঠতে, পাশ ফিরতে গেলেও মাথা ঘোরে। দাঁড়ালে পা টলমল করে। ঝুল ঝাড়তে গেলে মাথায় চক্কর দেয়। এই ধরনের সমস্যায় নিউরো এবং ইএনটি দু রকম চিকিৎসা করতে হয়।
অনেক রোগী আবার ‘নিউরোসাইনাইটিসে’ ভোগেন। এক্ষেত্রে মাথা ঘোরা, পড়ে যাওয়ার প্রবণতা তো থাকেই। সেই সঙ্গে হাঁটতে অসুবিধে হয়। বমি ভাব থাকে।
কোনও কারণে ব্রেনের পিছনে ব্লাড সার্কুলেশন কম হলে রোগী এক সময় ‘টিআইএ’ আক্রান্ত হন। অপর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ থেকে এই সমস্যা হয়। তার থেকে রোগী মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন  বয়স্ক মানুষদের নার্ভের সমস্যা থেকে পারকিনসন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই রোগেরই অন্যতম প্রকার ‘এমএসএ’। এক্ষেত্রে রোগী হাঁটাচলার সময় ব্যালান্স হারিয়ে ফেলেন। কথায় কথায় মাথা ঘোরে। হঠাৎ পড়ে যান।
চিকিৎসার জন্য সবার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
আর হ্যাঁ রোগীদের বলব—মাথা ঘুরলেই বসে পড়ুন। খুব উঁচু জায়গায় চড়বেন না। একটানা উপোস করবেন না। নিয়ম মেনে জল পান করুন। একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। নিয়মিত রক্তচাপ মাপান।
Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *