সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির জন্য উৎপাদিত মানসম্মত উন্নত ভোজ্যতেল সরকার দেশের স্থানীয় বাজারে বিক্রির অনুমতি দিতে পারে। এতে সরকারের আর্থিক সাশ্রয় ও দেশীয় রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এ ছাড়াও উচ্চমূল্যে ভোজ্যতেলের আমদানির লাগাম টানতে পারবে সরকার। ভোজ্যতেল বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের যথাযথ সহায়তার অভাবে রপ্তানিমুখী তেল পরিশোধন কারখানাগুলো বন্ধ হলে, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যা করোনাকাল ও করোনাভাইরাস পরবর্তীতে ভোজ্যতেলের চাহিদা ও আমদানির ক্ষেত্রে বড় ফারাক তৈরি করতে পারে।
ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান ‘এস জি অয়েল রিফাইনারি’ মোংলার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেডে) অবস্থিত। ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানাটি ৯০ ভাগ রপ্তানিমুখী আর ১০ ভাগ দেশীয় বাজারমুখী প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এস জি অয়েল রিফাইনারি কোম্পানি প্রায় ৫০ হাজার টন ভোজ্যতেল রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগ ভোজ্যতেল প্রতিবেশি দেশ ভারতে রপ্তানি হয়। গত জানুয়ারি থেকে ভারতে সীমান্ত পথে ভোজ্যতেল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। করোনার কারণে অন্যান্য দেশেও ভোজ্যতেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে আছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এস জি অয়েল রিফাইনারি উৎপাদিত ভোজ্যতেলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীরা সাফটার আওতায় ভারতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় ভোজ্যতেল রপ্তানির সুবিধা ভোগ করছিলেন। তবে দেশটির সরকারের নির্বাহী আদেশে চারমাস ধরে সেই সুবিধা বন্ধ করতে আমদানি নীতি সংশোধন করা হয়েছে। এর ফলে ৮ জানুয়ারি থেকে দেশটিতে আর ভোজ্যতেল রপ্তানি করতে পারছে না বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো। পার্শ্ববর্তী দেশটির হঠাৎ নিষেধাজ্ঞায় স্থলবন্দরে আটকে গেছে কনটেইনার ভর্তি কয়েক হাজার টন ভোজ্যতেল। আরও কয়েক হাজার টন ভোজ্যতেল এলসি করার পর সেগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশীয় কোম্পানিগুলো।
এ বিষয়ে এস জি অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সারোয়ার জাহান তালুকদার বলেন, একদিকে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে কারখানায় উৎপাদন বেড়েছে। ভোজ্যতেল উৎপাদন বেড়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, এখন ভোজ্যতেল রাখার জায়গা নেই আমাদের। ফলে রিফাইন করা ভোজ্যতেল নষ্ট হওয়ার উপক্রম । আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন উৎপাদিত ভোজ্যতেল স্থানীয়ভাবে বিক্রির অনুমোদন দেওয়া হলে-কারখানা চালু রাখা সম্ভব হবে। দেশের ব্যবসায়িরা এ ভোজ্যতেল কিনে দেশের মানুষের কাছে ভালোমানের ভোজ্যতেল বিক্রি করতে পারবেন। এর মাধ্যমে দেশের মানুষ উন্নতমানের স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্যতেল খাওয়ার সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, রির্জাভে থাকা ভোজ্যতেল বিক্রি হলে, কারখানা আবার উৎপাদনে যাবে। বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকরা আবার কাজে ফিরতে পারবে। সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো করোনাভাইরাসে দরিদ্র অসহায় মানুষের মধ্যে যে চাল-ডাল অনুদান দিচ্ছে সেখানে এস জি অয়েল থেকে ভোজ্যতেল কিনে সংযুক্ত করতে পারে। সরকার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্যে অতি দ্রুত ভারতকে নিষেধজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বলতে পারে। না হলে রপ্তানিমুখী তেল পরিশোধন কারখানাগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাবে। যা দেশের কর্মসংস্থান ও রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এস জি অয়েল রিফাইনারির বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি একজন দক্ষ শ্রমিক, আমাদের কারখানায় বিশ্বের এক নম্বর ভোজ্যতেল তৈরি হয়। এখানে কয়েকটি ধাপে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রপ্তানি বন্ধ হয়ে পড়ায় আমরা বেকার হয়েছি। বাণিজ্য মন্ত্রনালয় দেশে নিম্নমানের অনেক ভোজ্যতেল বিক্রির অনুমতি দিয়েছে। আমাদের এস জি অয়েল স্থানীয় বাজারে বিক্রির অনুমতি দিলে- দেশের সাধারণ মানুষ ভালোমানের ভোজ্যতেল ব্যবহার করতে পারবে। সরকারেরও বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে ভোজ্যতেল আমদানি করতে হবে না। তিনি আরও বলেন, কুয়েত থেকে আমার এক ভাই বেকার হয়ে দেশে ফিরেছে। করোনায় লাখ লাখ মানুষ বেকার হচ্ছে। এস জি অয়েল রিফাইনারি কোম্পানির উৎপাদিত ভোজ্যতেল সরকার দেশীয়ভাবে বিক্রির পারমিশন দিলে- এখানকার শত শত শ্রমিক কর্মহীন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
জানা যায়, বাংলাদেশে বছরে ৩০ লাখ টন ভোজ্যতেল ব্যবহার হয়। অয়েল ওয়ার্ল্ড ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তা সবচেয়ে বেশি। দেশে ভোজ্যতেলের ব্যবহার বাড়লেও উৎপাদন সে তুলনায় বাড়েনি। স্বাভাবিকভাবেই আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউয়ে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানিতে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে ১১৬ কোটি ১০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৮৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। তেলবীজ আমদানিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।
এনএমএস