আকাশ ইসলাম, বাগেরহাট প্রতিনিধিঃ তারিখ ২১ শে মে ২০২০। এইতো কয়েকদিন আগের কথা। বঙ্গোপসাগর হতে সৃষ্ট ঘূর্নিঝড় “আম্ফান” আঘাত হানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।তার সেই ছোবল থেকে পার পায়নি বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলাও। এভাবেই প্রতিবছরই কোন না কোন ঝড় বন্যায় উপকূলের কোন না কোন জনপদের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পানি আসে, তুফান আসে, আসে প্রলয়ংকরী ঝড়-জলোচ্ছাস। উপকূলের মানুষ মরে।
ফসলহানী ঘটে। তারই সাথে সাথে নিয়ে যায় হাজারো মানুষের বুক ভরা স্বপ্ন। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, বুলবুল ও আম্ফানের আঘাতে বিপর্যস্ত উপকূলের জনপদের এক একটি নাম রামপাল, মোংলা, শরনখোলা, মোড়লগঞ্জ, কচুয়া।তবে সুন্দরবনের কারনে টিকে আছে এখনও এ অঞ্চলগুলো।
ঘূর্নিঝড় “আম্ফান” এ ব্যাপক ভাবে ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের। ক্ষতি হয়েছে বনের গাছপালা সহ বন বিভগের স্থাপনা।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, “আম্ফান” এ গোটা সুন্দরবনে ১২ হাজারেরও বেশী গাছপালার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গরান,
কেওড়া, গেউয়া, বাইন, সুন্দরীগাছ সহ আর অনেক গাছ। এছাড়াও বনের অভ্যন্তরীন অফিস, আবাসস্থল, পন্টন, জেটি ও বনবিভাগের
ব্যবহৃত ১০ টি জলযান এর ক্ষতি হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ক্ষতির পরিমান দাড়িয়েছে ২ কোটি টাকার বেশী।
বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় ভেসে গেছে চার হাজার ৬৩৫টি মৎস্য ঘের। এ জেলার রামপাল, মোংলা, বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ,
শরণখোলা ও কচুয়ার সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাছের ঘেরের । চাষিদের স্বপ্ন ও ভরসা ভেসে গেছে বানের জোয়ারে। সরকারি
হিসেবে এতে প্রায় দুই কোটি ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে চাষিদের। তবে বেসরকারি হিসেবে ঘের ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও
অনেক বেশি।
বাগেরহাট সদর উপজেলার মাঝিডাঙ্গা গ্রামের নারী মৎস্য চাষি হালিমা বেগম বলেন, রাতের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে আমার ঘেরের
মাছ বের হয়ে গেছে। সকালে ঘেরে গিয়ে নেট দিয়েছি। কিন্তু মাছ যা বের হওয়ার রাতেই বের হয়ে গেছে।
রামপাল উপজেলার নান্টু মল্লিক বলেন, ঘেরে বিক্রয় যোগ্য অনেক মাছ ছিল এবং নতুন করেও কিছু পোনাও ছেড়েছিলাম। সব
মাছ বের হয়ে গেছে। করোনায় দুই মাস ধরে আয় বন্ধ। বিক্রয় যোগ্য মাছের দাম কম থাকায় বিক্রিও করতে পারিনি। এর মধ্যে
আবার আম্ফানে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সব মাছ। শুধু আমার নয় এই উপজেলার অনেকেরই ঘেরের মাছ এভাবে বের হয়ে গেছে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের জোয়ারের জলোচ্ছ্বাস ও অতিবর্ষণে উপকূলীয়
বাগেরহাটের ৪ হাজার ৬৩৫টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। এতে চাষিদের ২ কোটি ৯০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও বাগেরহাটে ৪ হাজার ৬৮৬টি কাঁচাঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। নষ্ট হয়েছে মাঠে থাকা সবজি, আমনের বীজতলা, পাকা ধানসহ
১৭শ’ হেক্টর জমির ফসল । এতে কৃষকদের সাড়ে ৬ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিধ্বস্ত ঘরগুলোর মধ্যে চার
হাজার ৩৩৯টি ঘর আংশিক এবং ৩৪৭টি ঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলার সদর উপজেলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বগী-গাবতলা এলাকার
অনেক পরিবার এখনও পানিবন্দি রয়েছে। এর বাইরে বাগেরহাট সদরের ভৈরব ও দড়াটানা নদীর তীরের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত
১৫টি স্থানে নদী সংলগ্ন সড়ক ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকছে। এতে জোয়ারের সময় পানিবন্দি হয়ে পড়ছে কয়েক হাজার মানুষ।
তবে এখনো আম্ফানে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে পূর্ণিমার প্রভাবে বলেশ্বর নদের জোয়ারের পানি হু হু করে ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে গ্রাম। দিনে
দুইবার ডুবছে বগী-গাবতলার তিন শতাধিক পরিবার। বসত ঘরের মধ্যে হাঁটু পানি। রান্না-বান্না বন্ধ। দুর্ভোগের আর শেষ নেই ওই
পরিবারগুলোর।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর ২৭ মে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অব.) জাহিদ ফারুক বাগেরহাটের শরণখোলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের
৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি বগী-গাবতলার দুই কিলোমিটার ভেঙে যাওয়া বাঁধ
সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে দ্রুত মেরামতের আশ্বাস দেন।
এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মন্ত্রী এসে বাঁধের আশ্বাস দিয়ে গেছেন। কিন্তু কাজের কোনো খবর নেই। এখন পানিতে ডুবে
মরতে হচ্ছে আমাদের। এভাবে কোনো মানুষ বসবাস করতে পারে?
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরদার মোস্তফা শাহিন জানান, বগী-গাবতলার ওই দুই কিলোমিটার এলাকা
সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে রিংবেড়িবাঁধ দেওয়ার কথা। ইতিমধ্যে তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রাথমিক জরিপ করেছেন। শিগগিরই
কাজ শুরু হতে পারে।
তবে ইতিমধ্যে বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ, শরনখোলা উপজেলায় ৪৫ টি ঘর বিতরন করেছেন সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর দেওয়া
ঘর পেয়ে খুশি আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থরা।
এদিকে মোংলা সহ আশে পাশের বেশ কিছু উপজেলায় ঘর বিতরনের কোন খবর পাওয়া যায়নি।তবে উপজেলা পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তদের
ঘর বিতরনের জন্য আবেদন সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা যায়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ আল মাসুম শরনখোলার ক্ষতিগ্রস্থ বাধ পরিদর্শন করেন এবং জানান, সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অতি
দ্রুত বাধ নির্মান ও সংস্কারের কাজ করা হবে।
এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ত্রান বিতরন করেছেন কোস্টর্গাড, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনী। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যদ্রব্য ও বাসস্থানের
জন্য টিন, সাবান, স্যানিটাইজার, ঘর বিতরন, বিশুদ্ধ পানি, স্যালাইন ও নগদ টাকা পৌছে দিয়েছে তারা।
এদিকে মোংলায় ঘূর্নিঝড় আম্ফানের তান্ডবের পর শুরু হয়েছে নদী ভাঙ্গন। নদী গর্ভে বসতভিটা দোকানপাট সহ বেড়িবাধের ১৮
কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন নদীর পশে বসবাসকারী ২০ হাজার মানুষ । এলাকায় দেখা গেছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। ভাঙ্গন ঝুকিতে
কয়েকশত পরিবার।
ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলবাসীরা বলেন, ঘরবাড়ি সব নদীতে চলে গেছে। থাকার মত জায়গা নাই। খোলা আকাশের নিচে ঝড়বৃষ্টিতে থাকতে হচ্ছে।
তার উপর বিশুদ্ধ পানির সংকট।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্থদের ঘর নির্মানসহ ত্রান দেওয়া হচ্ছে।
পরিবেশবিদ ও সাংবাদিক নুর আলম শেখ বলেন, বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন। যেকোন মূল্যে এ সুন্দরবনকে আমাদের রক্ষা করতে
হবে।শুধু সুন্দরবন নয় প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে আমাদের বাঁচতে হলে পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।