সোউগ কিছু ভাসি গেইছে, খালি জীবন নিয়্যা সতরি আচ্ছি

“বাবারে কি কইম দুখখের কথা, বানের পানিত বাড়ি ঘর সোউগ কিছু ভাসি গেইছে। খালি জীবন নিয়্যা বুড়্যা-বুড়ী সতরি আচ্ছি। পইশশো দিন থাকি এই বাঁধের পাড়ের আস্তার মদদে আচি। তিন দিন থাকি এই তাবু খ্যানের নিচোত না খ্যায়া, না দ্যায়া বুড়্যা-বুড়ী ঝড়ির পানিত ভিজবের নাগছি। বানের পানির স্রোতোত হামার ঘরের বেড়া, চেয়ার, টেবিল, চাউল, ডাইল, নাইজপাতি, পরের কাছোত থাকি দি নেওয়া ৭টা চড়াই সোউগ পানিত ভাসি গেইছে। এই বুড়্যা বয়োসোত ওসুক শরীল ধরি চইলব্যার পাং না। এলা মুই বুজব্যার পাবার নাগছোং না কি করিম।” এমনি করি আহত কন্ঠে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা বলছিলেন, কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার উত্তর মরাকাটা গ্রামের নদী রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নেয়া বয়সের ভাড়ে নুইয়ে পড়া ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ বরকত আলী। তার বাড়ী কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার ৬নং ওয়ার্ডের চর ভেলাকোপা গ্রামে।

মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টায় সরেজমিনে উত্তর মরাকাটা এলাকার নদী রক্ষা বাঁধে বরকতসহ অনেকের আশ্রয় নেয়ার এমন চিত্র দেখা যায়।

জানা যায়, প্রথম দফা বন্যায় বরকত আলীর বাড়িতে পানি উঠলে তার পরিবার সহ পানি না উঠা প্রতিবেশী ছামছুলের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই দ্বিতীয় দফা বন্যার আঘাতে ধরলার পানির প্রবল স্রোতে ভেসে যায় বরকতের বাড়ীর বেড়া, আসবাব পত্র, খাদ্য সামগ্রী ও ৭টি মুরগী। দ্বিতীয় দফা বন্যায় ছামছুলের বাড়ী তলিয়ে গেলে বৃদ্ধ বরকত ও তার স্ত্রী সংসারের কোন কিছু উদ্ধার করতে না পেরে জীবন বাঁচার তাগিদে পানিতে হাবুডুবু খেয়ে মৃত্যুর কোল থেকে সাঁতরিয়ে উঠে এসে আশ্রয় নেন উত্তর মরাকাটার নদী রক্ষা বাঁধে। কিন্তু কয়েক দিনের টানা বর্ষনে ভিজে ছোট্ট একটু তাবুতে অনাহারে,  অর্ধাহারে কোন রকমে দিনাতিপাত করছেন তারা।

বরকত আলীর স্ত্রী জানান, প্রথম দফা বন্যায় আমাদের বাড়ীতে পানি উঠেছে। পরে আমাদের এলাকার এক প্রতিবেশী ছামছুলের বাড়িতে পানি না উঠায় সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেই। কিন্তু দ্বিতীয় দফা বন্যায় তার বাড়িও ডুবে যায় এবং আমাদের বাড়ী ঘরের বেড়া, আসবাবপত্র, ঘরে থাকা খাদ্য সামগ্রী সহ ৭টি মুরগী পানিতে ভেসে যায়। পরে কোন কিছু উদ্ধার করতে না পেরে সাঁতরিয়ে আসি।

একই এলাকার বানভাসী ছামিনা জানান, আমরাও এই বাঁধে আশ্রয় নিয়েছি। আমাদেরও বাড়ীঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে বন্যায় বৃদ্ধ বরকত আলীর কষ্ট দেখে খুবই খারাপ লাগছে।

ঐ এলাকার আরেক বানভাসী আবেদ আলী জানান, আমার ৩টা হাঁস, ৩টা মুরগী ও ২টা ছাগল পানি থেকে উদ্ধার করার সময় ডুবে মারা গেছে। বাড়ীর বেড়া নষ্ট হয়েছে। গরু আছে দুইটা। সেই দুইটা অন্যের বাড়ীতে রেখেছি। আমরাও বরকতের মতই ক্ষতিগ্রস্ত।

উল্লেখ্য, কুড়িগ্রামে ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।

পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ৯ উপজেলার ৫৬ ইউনিয়নের প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। অনেকেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে পাকা সড়ক, উঁচু বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু সেখানেও বানের পানি আসতে শুরু করায় দুঃশ্চিন্তা ও দূর্ভোগে বানভাসি মানুষজন।

প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে পড়া কর্মহীন এসব মানুষের মাঝে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানিসহ দুর্ভোগ চরম আকার ধারন করেছে। অনেকে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর সর্দি, কাশি, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

আরও পড়ুন: হাপর আর লোহা পেটানোর শব্দে মুখর নাটোরের নলডাঙ্গা

তলিয়ে গেছে গ্রামীন জনপদ, কাঁচা পাকা সড়ক, বাজার-ঘাট, ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান সহ গুরুত্বপুর্ন প্রতিষ্ঠান সমুহ।  ব্যাহত হয়ে পড়েছে লোকজনের স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা।

জেলা প্রশাসন থেকে ১৬০ মেট্রিক টন চাল, ৮ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেয়া হলেও তা এখনও বিতরণ শুরু হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৯৩ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে ও তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *