একটু ভালোভাবে সংসার চালানোর জন্য বাবা-মায়ের জমি বিক্রি করে ও ধার নিয়ে স্বামী ফারুক হোসেনকে ২০১৬ সালে ইরাকে পাঠান লালমনিরহাটের রাশেদা বেগম।এক বছর পর থেকেই তার আর কোনো খোঁজ পাননি।দুই ছেলে নিয়ে সংসার চালাতে না পেরে চলতি বছরের শুরুতে শ্বশুরবাড়ি সদর উপজেলার কুলাঘাট থেকে একই জেলার বছিরটারী এলাকায় বাবার বাড়িতে চলে আসেন রাশেদা।
সংসার চালানোর জন্য রোজগারের কথা চিন্তা করতে থাকেন।কিন্তু এমন সময় করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বন্ধ হয়ে পড়ে সে পথ।
করোনা প্রতিরোধে চারদিকে মাস্ক ব্যবহারের প্রচার চলতে থাকে। সেলাইয়ের কাজ জানা রাশেদা চিন্তা করেন, মাস্ক তৈরি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি মানুষকে সচেতনও করা যাবে।
রাশেদার বড় ছেলে রউফ উজ্জামান রাহিদ লালমনিরহাট টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে রেজোয়ান আহমেদ রমিদ খার্দ্দসাপটানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে,৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে লালমনিরহাট সরকারি মডেল স্কুলে। দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালাতেই রাশেদার মাস্ক তৈরি শুরু।
রাশেদা বলেন, ‘তৈরির আগে মাস্কের নকশা তুলতাম খাতার কাগজ কেটে বা পুরান কাপড় কেটে। পরে বাজার থেকে ৬০ টাকা দরে দুই গজ মোটা সুতি কাপড় কিনে ২০টা মাস্ক বানাই। সেগলা রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করি ৩০ টাকা করে। সেদিন আয় হয় ছয়শ টাকা।
‘সেই টাকা দিয়ে পরের দিন সকালে দশ গজ কাপড় কিনে মাস্ক বানাই একশটা। বিক্রি করে আসে তিন হাজার টাকা। এভাবে মাস্ক বিক্রি করে টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে, চলতে থাকে মাস্ক বানানোর কাজ।’
দেড় হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি সেলাই মেশিন। বেশি মাস্ক তৈরি করে এবং পাইকারী ও খুচরা হারে সেগুলো বিক্রি করতে থাকেন শহরের অলিতে গলিতে, রাস্তায়, হাট-বাজারে।
রাশেদার মাস্ক বিক্রির খবর ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। খবর চলে যায় জেলা প্রশাসকের কাছে। তখন সহকারী কমিশনার (এনডিসির) মেহেদী হাসান দুই হাজার মাস্কের অর্ডার দেন। আগাম চার হাজার টাকা পেয়ে কয়েক থান কাপড় কিনে শুরু করেন অর্ডারের মাস্কের কাজ।
সে সময় থেকেই জেলা প্রশাসনের অর্ডার পেতে থাকেন তিনি। শুধু জেলা প্রশাসন না, জেলার পাঁচটি উপজেলার প্রশাসন অফিস, হাসপাতাল, দোকান, ওষুধের দোকানসহ অনেক জায়গায় মাস্ক বিক্রি শুরু রাশেদার।
লালমনিরহাটে কাপড়ের মাস্কের কথা বললেই সবাই রাশেদার নাম নেন। লালমনিরহাট পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাশেদুল হাসান রাশেদ তাকে একটি নতুন সেলাই মেশিন দেন।
বেশি অর্ডার আসলে তার বাড়ির পাশের সেলাইয়ের কাজ জানা নারীদের মাস্ক বানানোর কাজ দেন, যাতে সময় অনুযায়ী ক্রেতাদের অর্ডার সরবরাহ করতে পারেন।
মাস্ক বিক্রির টাকা দিয়ে রাশেদা এখন সংসার চালানো, দুই ছেলের লেখাপড়া, বাবা-মায়ের খরচ বহন করছেন।
রাশেদা জানান, উদ্যোক্তা হিসেবে জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার মাধ্যমে গত ২৪ নভেম্বর নারী উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে ঢাকায় আসেন তিনি।
জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কর্মকর্তা ফিরোজুর ইসলাম ফিরোজ বলেন, ‘রাশেদা এসে তার কষ্টের কথা বললে আমি তাকে সেলাই প্রশিক্ষণের কথা বলি। পরে তিনি এখানে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।’
বাবার বাড়িতেই মাস্ক তৈরির কাজ করেন রাশেদা। তাঁর কাজে সহায়তা করেন স্কুলছাত্রী আশা মণি, অঞ্জু আরাসহ আরও কয়েকজন। প্রতিটি মাস্ক তিন টাকা দরে তৈরি করে দেয় তারা। করোনাকালে কাজের সুযোগ পেয়ে আনন্দিত এই কর্মীরাও। আর রাশেদা বলছিলেন, ‘আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি।পেছনে ফিরে দেখতে চাই না।’ সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে চান, এটাই এখন স্বপ্ন রাশেদা খাতুনের।