লেখক:
আজ ২২ মে, আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। জীববৈচিত্রের কথা শুনলেই, প্রথম আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দরবনের চিত্র। তবে এই সময়ে সুন্দরবন আবারও প্রমাণ করল এটি বাংলাদেশের শুধু জীববৈচিত্রের সবচেয়ে বড় আধারই নয়, তা আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচও।
বরাবরই সুন্দরবন মাতৃসুলভ আচরণ করে আসছে। এবারও ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বাংলাদেশের লোকালয়ে আঘাত হানার আগেই তার প্রবল শক্তি হ্রাস করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ বনটি কতবার যে ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ থেকে রক্ষায় এবারও বুক পেতে দিল সুন্দরবন।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশে অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনের একটি উল্লেখযোগ্য নমুনা। এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি প্রকৃতি ভ্রমণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই বনকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসাবে ঘোষণা করা হয় বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। উল্লূকছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ এবং উদ্ভিদ।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর দিবসটির স্লোগান ঠিক করা হয়েছে ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষার সমাধান প্রকৃতিতেই’৷ করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রকৃতি যেভাবে আবার নিজেকে নিজের মতো করে সাজাচ্ছে, তার জন্যই এবারের প্রতিপাদ্যে এসেছে ভিন্নতা। বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক উৎসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, পরিবেশ দূষণসহ নানা মানবসৃষ্ট কারণে তা হুমকির মূখে পড়েছে। পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রাখতে জীববেচিত্র্য সংরক্ষণ টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য প্রাণীদের আবাসস্থল সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
১৯৯৩ সালের শেষদিকে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসটি পালনের জন্য ২৯ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশ এ দিবস পালন বন্ধ করে দিলে ২০০২ সালের ২২ মে দিবসটি পুনর্নির্ধারণ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। মূলত ১৯৯২ সালের ২২ মে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কনভেনশনে দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়
জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি। আয়তনে ছোট হলেও এ বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রানীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বনে প্রবেশের সাথে সাথেই নানা ধরনের বন্যপ্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ শোনা যায়। বনের মধ্যে প্রায় সারাক্ষণই সাইরেনের মত শব্দ হতে থাকে; প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরণের ঝিঁঝিঁ পোকা বা ক্রিকেটের শব্দ। লাউছড়ার জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। বানের গভীরে যদি চুপচাপ অপেক্ষা করেন তবে বন মোরগ, বানর, খরগোশ, হনুমান, নানা প্রজাতির পশুপাখির দেখা পেতে পারেন। এসব প্রাণী দেখতে বনের একটু গভীরে যেতে হবে। তবে খুব বেশি ভেতরে যেতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে। লাউয়াছড়া আছে বিরল প্রজাতির এশিয়ার (এখানকার এক কর্মীর কথামত) একমাত্র ‘কোরোফর্ম’ গাছ। এ বনে বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী (Hoolock Gibbon) উল্লুকের বসবাস। দুর্লভ এ প্রাণীটি বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এখন দেখা যায় না। বনের মধ্যে কিছু সময় কাটালেই উল্লুকের ডাকাডাকি কানে আসবে। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভাল্লুক, মায়া হরিন (বার্কিং ডিয়ার), অজগরসহ নানা প্রজাতির সাপ ও জীবজন্তু। উদ্যানের বন্য পাখির মধ্যে সবুজ ঘুঘু, বন মোরগ, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়লা, ঈগল, হরিয়াল, কালোমাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল. ধূসর সাত শৈলী, পেঁচা, ফিঙ্গে, লেজকাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালোমাথা বুলবুল, ধুমকল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বনের ভেতর অনেক ছোট-বড় পাহাড়ী ঝিরি রয়েছে। সেসব ঝিরিতে ছোট ছোট মাছ, সাপ, ব্যাঙসহ নানারকম ছোট জলজ প্রানী আছে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সরকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সরকারের পক্ষ থেকে তাই বনরক্ষী নিয়োগ দেয়া হয়, যারা বনের সার্বিক দেখভাল করে থাকেন। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে তাদের অবস্থাও নাজুক। প্রায়ই বনদস্যুদের দাপটে তাদের নাজেহাল হবার খবর পাওয়া যায়। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বনদস্যুরা ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আক্রমণ করে বন থেকে গাছ কেটে নিয়ে যায়। এছাড়া অধিক জনসংখ্যার জন্য সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে আবাস গড়ার কারণেও অনেক গাছপালা হারিয়ে যাচ্ছে এই বনাঞ্চল থেকে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ঘোর প্রভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক গাছ-গাছালি ও জীববৈচিত্র্য।
লাউয়াছড়ায় জীববৈচিত্র্য সর্ম্পর্কে কোন ধারণা না থাকলেও স্থানীয় মানুষ বুঝতে পারে, বন আর আগের অবস্থানে নেই। তাদের কয়েকজন জানান, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এখন আর আগের মত জম্মায় না, হারিয়ে গেছে, কিছু প্রজাতির প্রাণীগুলো। এক পরিসংখ্যান ও অনুযায়ী, এ বনের অসংখ্য প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বনের গাছে গাছে অগণিত বানর আর দেখা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাউয়াছড়ায় গাছ কেটে আবাস গড়ার কারণেও অনেক গাছপালা হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ বাদীরা বলছেন উদ্ভিত, পশু পাখি ও প্রাণীকুল প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে একেঅন্যের পরিপূরক। এ জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা ফলে অনেক প্রাণি
লাউয়াছড়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অনেক প্রাণী বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক দায়িত্ব। বাংলাদেশ এমন পরিবেশগত হুমকির মোকাবিলা করছে যা জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এটি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সমঝোতার পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব পরিধি থেকে সচেনতা বাড়াতে হবে। বর্তমান মাত্রার পরিবেশ দূষণ চলতে থাকলে পৃথিবীতে মানব অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
রফিকুল ইসলাম জসিম
লেখক-গণমাধ্যম কর্মী