শিপন নাথ: আজ ১২ জুন। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘COVID-19: Protect children from child labour, now more than’। এই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমগ্র বিশ্বে শিশুশ্রম বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তোলা এবং শিশুশ্রম প্রতিরোধে সম্ভাব্য করণীয় স্থির করা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০২ সাল থেকে জুন মাসের ১২ তারিখে দিবসটি পালন করা শুরু করে।
সংস্থাটি শিশুর অধিকার সুরক্ষা ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম প্রতিরোধের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে আসছে। প্রতিবছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮০টি দেশে দিবসটি পালিত হয়। সরকার জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রণয়ন করেছে ২০১০ সালে। এ নীতি বাস্তবায়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য গঠিত জাতীয় বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলো কাজ করছে। কোনো শ্রমিকের সন্তান যাতে শ্রমে নিযুক্ত না হয়, সেজন্য শ্রমিকের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে শিক্ষা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপে শিশুশ্রম নিরসনে জনসচেতনতা বেড়েছে।
আমরা বলতে পারি, দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ সমস্যা হলো শিশু শ্রম। বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশু শ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দুরবস্থা হচ্ছে শিশু শ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ। লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে এবং সংসারের অসচ্ছলতার গ্লানি একজন মা-বাবাকে বাধ্য করে তার সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৫-১৪ বছর বয়সী মোট শিশু জনসংখ্যার ১৯%, ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ২১.৯% এবং মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে তা ১৬.১%। অর্থনীতির খাত অনুযায়ী, শিশুশ্রমিকদের বণ্টনের চিত্র হচ্ছে: কৃষি ৩৫%, শিল্প ৮%, পরিবহন ২%, অন্যান্য সেবা ১০% এবং গার্হস্থ্যকর্ম ১৫%। কিন্তু পরিবহন খাতে শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য ব্যাপক। অর্থাৎ, যেখানে ০.১% মেয়ে শ্রমিক সেখানে ছেলে শ্রমিক হলো ৩%। তবে শিশুশ্রম নিয়োগের প্রায় ৯৫%-ই ঘটে অনানুষ্ঠানিক খাতে। এদের জন্য সাপ্তাহিক গড় কর্মঘণ্টা আনুমানিক ৪৫ এবং মাসিক বেতন ৫০০ টাকার নিচে। মেয়ে শিশুশ্রমিকের মাসিক বেতন ছেলে শিশুশ্রমিকের তুলনায় গড়ে প্রায় ১০০ টাকা কম। বাংলাদেশের আনুমানিক ২০% পরিবারে ৫-১৪ বছরের কর্মজীবী শিশু রয়েছে। এই সংখ্যা শহুরে পরিবারগুলির জন্য ১৭% এবং গ্রামীণ পরিবারের জন্য ২৩%।
মূলত, শিশু শ্রম প্রতিরোধে বাংলাদেশের আইন হলো, ন্যূনতম মজুরি অধ্যাদেশ (১৯৬১) কিশোরসহ সকল শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে এবং নিয়োগকারী কর্তৃক কিশোর শ্রমিককে (১৮ বছরের নিচে) এই অধ্যাদেশের আওতায় গঠিত বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের কম মজুরি প্রদান বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়েছে। দোকান ও স্থাপনা আইন (১৯৬৫) দোকানে বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ বছরের কমবয়সী শিশুনিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এই আইন ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তির জন্য শ্রমঘণ্টাও নির্ধারণ করে দিয়েছে।
কারখানা আইন (১৯৬৫) ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১৪ বছরের কমবয়সী ব্যক্তিকে নিয়োগদান নিষিদ্ধ করেছে এবং শিশু ও কিশোরের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রবিধান দিয়েছে। এছাড়া এই আইন কোন কারখানায় নারী শ্রমিকদের ৬ বছরের নিচে সন্তানদের লালন-পালনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়েছে। শিশু আইন (১৯৭৪) এবং শিশু বিধি (১৯৭৬) সকল ধরনের আইনগত প্রক্রিয়াকালে শিশুর স্বার্থ রক্ষা করবে। এই আইনে আলাদা কিশোর আদালত গঠনের জন্য বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু অপরাধী যদি যৌথভাবে একই অপরাধ করে থাকে তাহলেও তাদের যৌথ বিচার অনুষ্ঠান করা যাবে না। খনি আইন (১৯২৩) ১৫ বছরের কম বয়সের কোন ব্যক্তিকে কোন খনিতে নিয়োগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ১৫ থেকে ১৭ বছরের যুবকদের নিয়োগ প্রদান নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। শিশু নিয়োগ আইনে (১৯৩৮) বলা হয়েছে যে রেলওয়ের কয়েকটি কাজে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না এবং রেলওয়ে কারে অথবা বাসে অথবা কোন বন্দরের অধীন এলাকায় শিশুরা কোন দ্রব্য বিক্রয় করতে পারবে না। শিশু (শ্রম অঙ্গীঁকার) আইনে (১৯৩৩) ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুর শ্রম চুক্তির অঙ্গীকার অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।
আইএলও জাতিসংঘের একটি বিশেষায়িত সংস্থা। ১৯৯২ সালে আই এল ও’র আন্তর্জাতিক শিশু শ্রম দূরীকরণ কর্মসূচী যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ৮০টি দেশে এই কর্মসূচী চালু আছে। ১৯৯৮ সালে আইএলও সর্বসম্মতিক্রমে কর্মক্ষেত্রে মৌলিক নীতি ও অধিকার সম্পৃক্ত ঘোষণা গ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে আইএলও কর্মক্ষেত্রে নীতি ও অধিকার এর সাথে শিশুশ্রম দূরীকরণ এর দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যাক্ত করেছে।
সুতরাং, আমাদের সকলের উচিত আমরা যেন আমাদের চারপাশে শিশুশ্রমের কুফল মানুষের মাঝে তুলে ধরতে পারি। প্রশাসনের উচিত সেই লক্ষ্যে নিয়েই কাজ করে যাওয়া। তার সাথে সাথে যারা অসচ্ছল তারা যেন তাদের শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেঁলে না দেয় সেদিকে আমাদেরকে সামাজিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সেই সাথে আমাদের সকলের উচিত প্রতিটি শিশুর লেখাপড়ার জন্য তাদের পরিবারকে উৎসাহিত করে তোলা। কেননা “সরকার সবার জন্য শিক্ষা”-এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যদি সকলেই এই শিশুশ্রম এর ব্যাপারে জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসি, তাহলে আমাদের দেশ সহ এই পৃথিবী একদিন শিশুশ্রম মুক্ত হবে। আমাদের পৃথিবীটা হবে একটি সুন্দর সুস্থ ও সচ্ছল পৃথিবী। দূর হয়ে যাবে শিশুদের ওপর থেকে তাদের শৈশব থেকে কেড়ে নেওয়ার স্মৃতিগুলো। হেসে উঠবে প্রতিটি শিশু তার শৈশব কে উদযাপন করে। আর সেই সাথে আমাদের আগামী প্রজন্ম হবে একটি সুন্দর নির্মল ও স্বাস্থ্য সমৃদ্ধ প্রজন্ম।