চট্টগ্রামে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি; গণপরিবহণ ডেকে আনতে পারে গণ-সংক্রমণ

কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে সরকারি সাধারণ ছুটি ঘোষণা থাকায় দীর্ঘ দুই মাস পর বন্দরনগরী চট্টগ্রামে সচল হয়েছে গণপরিবহণ। নগর পুলিশ ১৬ শর্ত সাপেক্ষে গণপরিবহণ চালুর অনাপত্তিপত্র দিলেও কার্যত মানা হচ্ছে না সেইসব শর্ত।

রাস্তায় চলাচলরত বাস বা স্টাফ বাসে নেই হ্যান্ড-স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশকের মতো কোনো সুরক্ষা-সামগ্রী। শুধু কয়েক সড়কে সিটের দূরত্ব বজায় রাখলেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহণে স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো মানসিক অবস্থা ও পরিবেশ আমাদের এখানে নেই। সুতরাং আমরা আরও বড় রকমের ঝুঁকির দিকে এগুচ্ছি।

এমনিতেই গণপরিবহণ সংকটের কারণে নাজুক চট্টগ্রাম নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার চিত্র। তার উপর ‘অর্ধেক যাত্রী’ পরিবহণের নির্দেশনা যেন সড়কের নতুন বিষফোঁড়া! সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত সময়েপযোগী; কিন্তু নগরীর জর্জরিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে এসব সিদ্ধান্ত মেনে চলা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বরঞ্চ সৃষ্টি হবে গণরোষ।

এদিকে স্বাস্থ্যবিধির শুরুতেই বলা হয়েছে, পাশাপাশি দুইটি আসনের একটিতে যাত্রী বসে অন্যটি ফাঁকা রাখতে হবে। কিন্তু কোনও আসন ফাঁকা না রেখেই শুধু ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছে গণপরিবহণ। নিরাপদ দূরত্ব না মেনে শুধু ব্লিচিং পাউডার ছিটানো ও মাস্ক ব্যবহার করায় সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় বাসের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটাই কম হলেও সিএনজি ও লেগুনা চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হয়েছে। কিছু কিছু সিএনজিও গণপরিবহণের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো পরিবহণেই নিরাপদ দূরত্বের কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। তাছাড়া যাত্রীদের সবাই মুখে মাস্ক রাখলেও কেউ কেউ মুখের মাস্ক চিবুকে আটকে রেখে নাক-মুখ খোলা রেখেছেন।

বাসে প্রবেশের সময়ে পানিতে মেশানো ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত থাকার চেষ্টা করছেন বাস-হেলপাররা। বাসে আসনসংখ্যা অনুযায়ী যাত্রী নেয়া হচ্ছে।
বাসে চড়ে নিউ মার্কেট থেকে বহদ্দারহাট থেকে যাওয়া একজন যাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, কর্পোরেট অফিসে কাজ করলেও বেতন পাই সরকারি অফিসের পিয়নের সমান। যার ফলে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে কর্মস্থলে যাতায়াত করা সম্ভব না। যা হবে, তা দেখা যাবে। করোনার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে পেটের খিদেয় মারা যাবো।

ওসমান নামের ১নং রুটের একজন চালককে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনায় যে হারে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে, এটা দেখে আমাদের সাবধান হওয়া দরকার। আমরা যদি সাবধান না হই, নিজেরাই মারা যাবো। আর নিজের মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর হলো পরিবারের অন্য কারো মৃত্যু। আমি এখন বাড়ির পাশের একটি খামারে কাজ করছি। করোনা চলে গেলে তারপর আমি গাড়ি নিয়ে বের হবো।’

মঙ্গলবার সকালে নগরীর চকবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় বড়ো কোনো বাস নেই। আছে শুধু মিনি বাস ও টেম্পো। সেগুলোর কোনোটিতেই হ্যান্ড-স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক সামগ্রী ছিল না। তবে ড্রাইভার-হেলপার ও যাত্রীরা সবাই মাস্ক পরেছেন।

হালিম নামের এক যাত্রী জানায়, তিনি মুরাদপুর থেকে দেওয়ানহাট যাচ্ছেন। বাসের সিট অনুযায়ী যাত্রী, তাই চাপ নেই। তবে তিনি বাসে কোনো হ্যান্ড-স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য-সামগ্রী দেখেননি।

ইপিজেড এলাকায়ও কিছু গণপরিবহণে শুধু শারীরিক দূরত্বে বসার মাধ্যমেই স্বাস্থ্যবিধি সীমাবদ্ধ ছিল। বেশিরভাগ গণপরিবহণের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না।

চিন্তার কারণ হলো, মানুষের মাঝে করোনা থেকে বাঁচার তাগিদের চেয়ে বেশি জোর ছিল কার আগে কে গাড়িতে উঠবে। তাছাড়া গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপারের মাঝেও স্বাস্থ্য-সচেতনতার বিষয়টি ছিল উপেক্ষায়। কিছু কিছু গাড়িচালকের  মুখে মাস্ক পর্যন্ত দেখা যায়নি। কিছু গাড়ি ব্যতিক্রম থাকলেও তাতে শুধু আসন ফাঁকা ছাড়া অন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।

বাস-শ্রমিক হুমায়ূন বলেন, সীমিত পরিসরে হলেও সরকার গণপরিবহণ চালু করেছে। এতে আমরা খুশি। অন্তত এখন না খেয়ে মরতে হবেনা।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহণ মালিক সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, আজকে প্রায় দুই মাসের বেশি সময় পরে ৭০ ভাগ গণপরিবহণ সড়কে নেমেছে। কাউন্টার সার্ভিসে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। লোকাল সার্ভিসের ক্ষেত্রে কিছু কিছু যাত্রী, চালক ও সহকারীর অসচেতনতা মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে। যদিও প্রশাসন কঠোরভাবে স্বাস্থ্যসুরক্ষা মানার বিষয়টি তদারকি করছেন।’

গণপরিবহণ মালিক সমিতির পরিসংখ্যানমতে, চট্টগ্রাম নগরে ১ হাজার ১৫০ থেকে ১২শো বাস, দেড় হাজার হিউম্যান হলার ও ১ হাজার ৭০০ লেগুনা চলাচল করে। আজকে যারা রাস্তায় নামেনি, তাদের কেউ কেউ গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে নিচ্ছেন, কেউ কেউ জীবনের প্রতি মায়া রেখে রাস্তায় নামছেনা।

আইইসিডিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, সারাবিশ্বের মতো আমাদেরও আজকে নতুবা কালকে সবকিছুই খুলতে হতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে জনসমাগম যেন না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। অথচ এখনই সব খুলে দেয়া হয়েছে। এখন পরীক্ষামূলক কিছু করার সময় নয়। আমাদের বুঝতে হবে, আক্রান্ত সংখ্যা বাড়ানোর মতো কিছু করার আগে আমাদের টেস্টের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন।

চসিকের কাউন্সিলর জিয়াউল হক বলেন, যাত্রীরা যারা আছেন তাদেরও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। গাড়িতে কী সুবিধা ভোগ করবেন, কোনটা স্বাস্থ্যবিধির লঙ্ঘন- সেটাও যাত্রীদের জানা জরুরি।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সিএমপির জুড়ে দেওয়া ১৬ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার কাজ ‘কিছুটা’ কঠিন হলেও সম্ভব। কিন্তু সড়কের বাস্তব চিত্র বলছে, করোনা মোকাবেলার এসব নির্দেশনার তোয়াক্কা করছেন না গণপরিবহণের চালকরা। সেইসাথে নিজেকে অতিরিক্ত হিসেবে ধরে নিয়ে বাসে গাদাগাদি করে ঝুলছে যাত্রীরা। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যসুরক্ষা মানার নাম নেই সড়কে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে অল্প কয়েকদিনে করোনা বিষের বিষ্ফোরক হয়ে উঠবে অনিয়মে চলা সড়কের এসব যাত্রী-চালক।

সূত্রমতে, ৬০ লাখ মানুষের বন্দর নগরীতে গণপরিবহণের সংখ্যা সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার। অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সংস্থা বলছে, স্বাভাবিক অবস্থায় এই নগরীতে এসব গণপরিবহণ ব্যবহার করার জন্য প্রতিদিন নগরীতে নেমে আসেন ২৫ থেকে ৩০ লাখ যাত্রী। সহজ সমীকরণে বলা চলে, গণপরিবহনের প্রতি সিটের বিপরীতে আছেন কমপক্ষে ৯ থেকে ১১ জন যাত্রী। তবে বর্তমান করোনাকাণ্ডে স্কুল-কলেজগুলো এখনও পর্যন্ত বন্ধ থাকার কারণে এই চাপ কিছুটা কম।

সড়কের এমন নাজুক অবস্থায় করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ‘অর্ধেক যাত্রী’ নেওয়ার নির্দেশনা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর সম্ভব? এমন প্রশ্নের উত্তরে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মোটেও সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি বড়জোর ২/৪ দিন পর সব আগের মত লেজে-গোবরে হয়ে যাবে।’

অবশ্য অবস্থা লেজে-গোবরে হতে ২/৪ দিন সময় লাগেনি। সোমবার (১ জুন) গণপরিবহণ চালুর কথা থাকলেও রোববার (৩১ মে) সকাল থেকেই নগরীর আগ্রাবাদ, হালিশহর, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেইট, জিইসি মোড়, একেখান, আন্দরকিল্লা, বহদ্দারহাট এলাকায় গাদাগাদি করে অতিরিক্ত যাত্রী ঝুলিয়ে রীতিমত ‘শো-ডাউন’ করেছে বেশকিছু গণপরিবহণ।

ট্রাফিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত গণপরিবহণ সংকটের কারণে সড়কে এমন বিশৃঙ্খলা।  কাজেই বলা চলে এই পরিস্থিতি সহসাই দূর হচ্ছে না। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে গাড়ির চাকা ঘুরলেই সচল থাকবে দেশের অর্থনীতি। তাই অতি স্পর্শকাতর ও ছোঁয়াচে এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে সড়কে সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অফিস-আদালতে শুরু ও শেষের  ভিন্ন ভিন্ন সময় নির্ধারণ করে দিয়ে সড়কে একসাথে নেমে আসা যাত্রীর স্রোত বন্ধ করতে হবে।

অন্যদিকে সড়কে চালু হওয়া নতুন নির্দেশনার ব্যাপারে জানতে চাইলে সিএমপি ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (উত্তর) মো. মহিউদ্দিন খান জানান, সিএমপির দেওয়া ১৬ নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করতে বলা হয়েছে ট্রাফিক সদস্যদের। সেই সাথে ব্যক্তিগত করোনা সংক্রমণ রোধে যাত্রী-চালকদের সুরক্ষা ব্যাবস্থাপনা মেনে চলার অনুরোধ জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও ৬০ ভাগ বাসভাড়া বাড়িয়ে গণপরিবহণ চালানোর সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। এ নির্দেশনা ৩১ মে থেকে চট্টগ্রাম নগরীসহ সারা দেশে কার্যকর হয়। এর আগে গত মার্চ মাসের শুরুর দিকে করোনা ঠেকাতে গণপরিবহণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *