আজ কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মদিন

শিপন নাথ: আজ ২১ জুন। কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মদিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, শ্রেণীসংগ্রাম, সামরিকতন্ত্র, ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরোধিতা, প্রেম-বিরহ, নারী, জীবন-প্রকৃতি আর স্বপ্ন দেখার অলীক ঘোর তার কবিতার প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কবিতার প্রধান দিকপালদের একজন তিনি। 

কবি নির্মলেন্দু গুণের পারিবারিক নাম নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। নির্মলেন্দু গুণেই তিনি সমধিক পরিচিত। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জরপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও তার স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি, ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন।

কবির জন্ম ১৯৪৫ সালে কাশবন, বারহাট্টা, নেত্রকোণায়। তার ছেলেবেলা কাটে নেত্রকোণার বারহাট্টা উপজেলার কাশবনে। বাবা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ এবং মা বিনাপনি। বাবা-মার তিন মেয়ে এবং দুই ছেলের মধ্যে নির্মলেন্দু ছোট ছেলে। চার বছর বয়সে মার মৃত্যুর পর তার বাবা আবার বিয়ে করেন চারুবালাকে।

নতুন মার কাছেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় তার। প্রথমে বারহাট্টার করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউটে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। দুই বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পান ১৯৬২ সালে।  মাত্র ৩ জন প্রথম বিভাগ পেয়েছিল স্কুল থেকে৷। মেট্রিক পরীক্ষার আগেই নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’৷

মেট্রিকের পর আইএসসি পড়তে চলে আসেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের সুবাদে পাওয়া রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপসহ পড়তে থাকেন এখানে। নেত্রকোনায় ফিরে এসে নির্মলেন্দু গুণ আবার ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকা ও তার কবি বন্ধুদের কাছে আসার সুযোগ পান। নেত্রকোনার সুন্দর সাহিত্যিক পরিমন্ডলে তাঁর দিন ভালোই কাটতে থাকে৷ একসময় এসে যায় আই.এস.সি পরীক্ষা৷ ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আই.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মাঝে তিনিই একমাত্র নেত্রকোনা কলেজের৷

বাবার ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হবে। কিন্তু না, তিনি চান্স পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে। ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ। হঠাৎ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় ঢাকায়। দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে। ঢাকার অবস্থার উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তার নাম ভর্তি লিস্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেয়া হয়েছে। আর ভর্তি হওয়া হলো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফিরে আসেন গ্রামে।

আই.এস.সি-তে ভালো রেজাল্ট করায় তিনি ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। মাসে ৪৫ টাকা, বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা। তখনকার দিনে অনেক টাকা বৈকি! ১৯৬৯ সালে প্রাইভেটে বি.এ. পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে আবার বুয়েটে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সাংবাদিকতায়ও জড়িত ছিলেন।

নির্মলেন্দু গুণের বেশিরভাগ কবিতায় অত্যাধুনিক দৃষ্টান্তবাদিতা পরিলক্ষিত। তার নারীপ্রেমার্দ্র কবিতাগুলো ভারতীয় আবেগ-অনুভূতি সংলগ্ন। তিনি দেশপ্রেমের যে-দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সত্যিই বিরল। ৬৬’ এর ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলেন তিনি; এরপর বাদ পড়েনি স্বাধীনতার পূর্বের ও পরের কোনো বিপর্যয়, যতবার এ রাষ্ট্র বিপথগামী হয়েছে- কলম ধরেছেন তিনি, লিখেছেন একের পর এক শ্রেণীসংগ্রাম এবং স্বৈরাচার-বিরোধী কবিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার পর প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে তাকে নিয়ে যে-ক’জন কবি ও লেখক সোচ্চার হয়েছেন তাদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯৭০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হবার পর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ-গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। কবিতার পাশাপাশি ভ্রমণ কাহিনীও লিখেছেন। নিজের লেখা কবিতা এবং গদ্য সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য হলো- ‘অনেক সময় কবিতা লেখার চেয়ে আমি গদ্যরচনায় বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষ করে আমার আত্মজৈবনিক রচনা বা ভ্রমণকথা লেখার সময় আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমি যে গদ্যটি রচনা করতে চলেছি, তা আমার কাব্য-রচনার চেয়ে কোনো অর্থেই ঊনকর্ম নয়। কাব্যকে যদি আমি আমার কন্যা বলে ভাবি, তবে গদ্যকে পুত্রবৎ। ওরা দুজন তো আমারই সন্তান। কাব্যলক্ষ্মী কন্যা যদি, গদ্যপ্রবর পুত্রবৎ।” বহুল আবৃত্ত কবিতাসমূহের মধ্যে – হুলিয়া, অসমাপ্ত কবিতা, মানুষ (১৯৭০ প্রেমাংশুর রক্ত চাই), আফ্রিকার প্রেমের কবিতা (১৯৮৬ নিরঞ্জনের পৃথিবী) – ইত্যাদি অন্যতম।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পদক (১৯৮২), একুশে পদক (২০০১) এবং স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৬) পেয়েছেন।

তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম হলো- ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’, ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’, ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘দূর হ দুঃশাসন’, ‘চিরকালের বাঁশি’, ‘দুঃখ করো না, বাঁচো’, ‘আনন্দ উদ্যান’, ‘পঞ্চাশ সহস্র বর্ষ’, ‘প্রিয় নারী হারানো কবিতা’, ‘শিয়রে বাংলাদেশ’, ‘ইয়াহিয়াকাল’, ‘আমি সময়কে জন্মাতে দেখেছি’, ‘বাৎস্যায়ন’, ‘রক্ষা করো ভৈরব’ ইত্যাদি। ‘আপন দলের মানুষ’ শিরোনামে রয়েছে তার একটি গল্পগ্রন্থ।

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *