শুভ জন্মদিন কিঙ্কর আহসান

শিপন নাথ: বর্তমান বাংলা সাহিত্যে তরুণ লেখক পাড়ায় রয়েছেন ত্রিরত্ন যারা হলেন সাদাত হোসাইন, কিঙ্কর আহসান এবং আবদুল্লাহ আল ইমরান। যাদের বইয়ের পরিসীমা শুধু বাংলাদেশেই নয়। সমগ্র বিশ্বে পাঠকনন্দিত। বিশেষ করে ভারতে বেশ সাড়া ফেলেছে তাদের বই। আজ ত্রিরত্নের একজন কথাসাহিত্যিক কিঙ্কর আহসানের জন্মদিন।

১৯৮৯ সালের ৬ই জুলাই কুষ্টিয়ায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান সময়ের অন্যতম লেখক কিঙ্কর আহসান। কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও পড়াশোনার শুরুটা হয় বরিশালে। যেখানে কেটেছে তার দূরন্ত শৈশব। বাবার চাকরিসূত্রে আবার পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় চলে আসেন ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন স্বনামধন্য ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি দিয়েছেন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে।

মধ্যবিত্ত জীবন। সাদামাঠা মন। দুরন্ত শৈশবের প্রখর হাতছানি। এই নিয়েই চলছে অত্যন্ত বিনয়ী স্বভাবের এই লেখকের জীবন। লেখালেখির সুবাদে বেশ কয়েকটি জায়গায় কিঙ্কর আহসান কোনো অনুষ্ঠানে বলেন, “শৈশব এমন একটা সময় যখন জীবন এতটা জটিল থাকে না। অন্য একজন কি বললো বা সমাজ কি বললো, এসব নিয়ে ভাবনা আসে না। শৈশবটা বরাবরই সহজ সরল এবং দূরন্ত মধুর।”

বাবার দেয়া টাকা থেকে টাকা জমিয়ে চলে যেতেন সিনেমা হলে কিংবা বইয়ের দোকানে। গিয়েই কিনে ফেলতেন মাসুদ রানা, তিন গোয়েন্দা, কমিক্সের বই থেকে শুরু করে নানান বই। গোয়েন্দা কাহিনীই প্রাধান্য পেত সেসবে। বাবা ৩ টাকা করে দিতেন পকেট খরচের জন্য। বাবার দেয়া সেই ৩ টাকার মধ্য থেকেই টাকা জমিয়ে ৩০ টাকা দিয়ে লাইব্রেরীর সদস্য হতেন কিঙ্কর, ২ টাকা দিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য বই ভাড়া নিতে পারতেন। পড়া শেষ করে আবার ফেরত দিয়ে অন্য বই নিয়ে আসতেন।

লেখক খেলাধুলায় যেমন আগ্রহী ছিলেন, পড়াশুনায়ও ঠিক ততোটাই। পড়াশুনাটা তার কাছে ছিল গল্পের বইয়ের মত। অংক যেন মাথার উপর দিয়েই যেত সবসময়। অংকে ছিলেন বড্ড কাঁচা, যদিও সাইন্স নিয়ে পরবর্তীতে পড়েছেন। ছোট্টবেলার সেই ইত্যাদি, টিপু সুলতান দেখতে দেখতে কখন যে কিঙ্কর আহসান বড় হয়ে গেলেন তা যেন তার আফসোসের মধ্যেই শুনতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসে ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করেন তিনি। কলেজ জীবন শেষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্য বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেমন ছিল তা যেন না বললেও সহজেই ধরে ফেলা যায়। একাধিক সংগঠনের সঙ্গে জড়ানো থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক অনেক গ্রুপে একাধারে কাজ করেছেন কিঙ্কর আহসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্লাবে যুক্ত থেকে সাহিত্য অঙ্গনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, কাজ করেছেন। সক্রিয় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখক সংঘ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, কন্ঠশীলন, মুক্তআসর, বিল্ড বেটার বাংলাদেশসহ আরও অনেকগুলো সংগঠনের সাথে। করেছেন সামাজিক কল্যাণমূলক কাজও। পুরো ক্যাম্পাস দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ছোট্টবেলার সেই দূরন্ত কিঙ্কর আহসান।

ক্লাস এইট কিংবা নাইনে ডায়েরী কিংবা সুন্দর খাতায় লেখালেখির শুরু। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় দেশের দৈনিক পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে৷ অবাক হলেও সত্য এই কিঙ্কর আহসান এতসব সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও দেশের জনপ্রিয় সব দৈনিক পত্রিকায় লিখে গেছেন দিনের পর দিন। বছরের হিসাবে পাঁচ বছর হবে। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে শুরু করে প্রথম আলো, কালের কন্ঠ, বাংলা নিউজ সহ দেশের শীর্ষ সারির সব দৈনিক পত্রিকাতেই লিখেছেন কিঙ্কর আহসান। অনলাইন পোর্টালেও তিনি লিখালিখি করতেন। বিভিন্ন জায়গায় তিনি ছোটগল্প লিখতেন। ছোটগল্প লেখার পাশাপাশি তিনি শিক্ষানবিশ সাব-এডিটর ছিলেন কালের কন্ঠের ‘বাতিঘর’ পাতায়। ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ টিভি শো’তে সহকারী স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেছেন। আরও বেশ কিছু জায়গার প্রধান স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে তিনি যুক্ত ছিলেন। সেই জায়গাগুলো হলো মার্কস অলরাউন্ডার’, ‘হ্যান্ডসাম দি আলটিমেট ম্যান পাওয়ার্ড বাই বাংলাদেশ নেভী’, ‘হাসতে মানা’ ও ‘বাংলাদেশ সুপার লীগ-গ্রান্ড লোগো আনভেইলিং’। লেখালেখির কাজে তখন তিনি বেশ পটু। সুন্দর, চমৎকার সব লেখনির মাধ্যমে তখন থেকেই তার পাঠক মহলের যাত্রা শুরু। প্রতিনিয়ত পত্রিকায় লিখালিখি করতে করতে একটা সময় যখন পাঠকদের একটা গোষ্ঠী তৈরী হয় যারা কিঙ্কর আহসানের লেখা প্রতিনিয়ত পড়ে, তাদের জন্য তখন কিঙ্কর আহসান বই লেখার পরিকল্পনা করেন। লেখালেখির পাশাপাশি টেলিফিল্মের কাজও করেছেন কিঙ্কর আহসান। ‘জলপরানি’, ‘পাতার নৌকা’ ও ‘ক্রিং ক্রিং’ টেলিফিল্মের কাজ দিয়ে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন কিঙ্কর আহসান।

এরপর বিজ্ঞাপনী সংস্থায়ও তিনি যুক্ত হন৷ বিজ্ঞাপনের গল্প নির্মাণে সহায়তা করেন৷ গল্প লিখেন, ডিরেকশন দেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ক্রিয়েটিভ সেক্টরে কাজ করেন৷ বিজ্ঞাপন নির্মাণেও যেন তিনি বেশ পটু। দেশের নামকরা জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনগুলোর বেশিরভাগের গল্প কিঙ্কর আহসানের লেখা। কিঙ্কর আহ্সান চ্যানেল আইয়ের আই পজেটিভ এ ক্রিয়েটিভ গ্রুপ হেড হিসেবে কাজ করেছেন। সান কমিউনিকেশন এ চাকরি এবং এশিয়াটিক জেডব্লিউ টি এর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করার পর বর্তমানে কর্মরত আছেন আজিয়াটার ‘আডা’ তে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে। বিভিন্ন দিবসের বিভিন্ন গল্প নিয়ে হৃদয় ছোঁয়া সব বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন বেশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সাথে ডকুমেন্টারি নির্মাণের কাজও করেছেন সর্বজন সমাদৃত কিঙ্কর আহসান।

দিনশেষে কিঙ্কর আহসান নিজেকে যা হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তা হলো ‘লেখক’ এবং তার প্রিয় সব কাজের উর্ধ্বে হলো ‘বই’ লেখা। এই পর্যন্ত ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে কিঙ্কর আহসানের। আঙ্গারধানি (উপন্যাস), কাঠের শরীর (গল্পগ্রন্থ), রঙিলা কিতাব (উপন্যাস), স্বর্ণভূমি (গল্পগ্রন্থ), মকবরা (উপন্যাস) ও আলাদিন জিন্দাবাদ (গল্পগ্রন্থ), মখমলি মাফলার, কিসসাপুরণ, মধ্যবিত্ত (উপন্যাস), রাজতন্ত্র (উপন্যাস), মেঘডুবি (উপন্যাস) এবং বিবিয়ানা (উপন্যাস)। মধ্যবিত্ত, মেঘডুবি এবং বিবিয়ানা দিয়ে পাঠক মহলের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এতকিছু লিখলেও লেখকের ব্যক্তিগত পছন্দ ছোট গল্প। বইমেলা এলে লেখকের প্রাণ যেন আরও চঞ্চল হয়ে উঠে। প্রাণের প্রিয় এই মেলার সময়টাই যেন সবার প্রিয়। বই নিয়ে এই মেলা সেইক্ষেত্রে কিঙ্কর আহসানের কতোটা প্রিয় হতে পারে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

প্রথম প্রথম পরিবারে কিঙ্কর আহসানের বাবা তার লেখালেখিকে ভালোভাবে না নিলেও একটা সময়ে এসে লেখকের প্রধান সাহসে পরিণত হন। লেখকের পাঠক শুধু এই দেশেই নয়, বরঞ্চ দেশের বাইরেও লেখকের প্রচুর পাঠক রয়েছে। চিকিৎসার কারণে লেখক যখন তার বাবাকে নিয়ে কলকাতায় যান, কলকাতার প্রচুর পাঠকেরা কিঙ্কর আহসানের বাবাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। সাধারণ মানুষের এই ভালোবাসা দেখে লেখকের বাবা মুগ্ধ হন এবং হয়ে উঠেন নিজের সন্তানের সবচাইতে বড় শক্তি। এই অর্জন কিঙ্কর আহসানের সবচাইতে বড় অর্জন৷ অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে এই বিষয়েও।

কলকাতায় লেখককে “মহাশ্বেতা দেবী সাহিত্য পুরষ্কার” পদকে ভূষিত করা হয়। এর পাশাপাশি লেখকের অর্জনের ঝুলি কিন্তু অনেক বড়। এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা বর্তমান সময়ের অন্যতম বিনয়ী একজন মানুষ হয়ে উঠবে এই কথা কে জানতো। সেই পরিবারটি এখন লেখককে নিয়ে অনেক বেশি গর্বিত। দেশ বিদেশের হাজারও মানুষ আজ কিঙ্কর আহসানের লেখাকে ভালোবাসে। লেখকের ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসে।

সাহিত্য নিয়ে কাজ করার প্রচন্ড ইচ্ছা নিয়ে বেড়ে উঠা এই লেখকের মন টানে এই পৃথিবীতে যেন বইয়ের কথা ছড়িয়ে যাক। পৃথিবীটা যেন বইয়ের হয়। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে লেখকের এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে এই লেখা দেখতে পাওয়া যায়। বিলবোর্ডে বড় করে লেখা থাকে ‘পৃথিবী বইয়ের হোক’। কলকাতা, জাপান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের বইমেলা ভ্রমণ করতে বেশ ভালোবাসেন কিঙ্কর আহসান। বইয়ের জন্য ছুটে চলেন এদেশ থেকে সেই দেশ। বিভিন্ন দেশের বইমেলা ভ্রমণ করার সুবাদে সেসব দেশের লেখক-পাঠক সম্প্রদায়ের সাথে মেশার সু্যোগ হয়। ওসব দেশের বই নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ দেখার সু্যোগ হয়। এই বিষয়ে বেশ আক্ষেপ জন্মায় লেখক কিঙ্কর আহসানের মনে। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নেই এত আগ্রহ। লেখকদের নেই পর্যাপ্ত সম্মান। বইয়ের গল্প কম হয়। বই নিয়ে মানুষ আগ্রহী হয় না। পহেলা ফাল্গুনে পঁচিশ লক্ষাধিক মানুষ বইমেলায় গেলেও বই বিক্রি হয় কয়েক হাজার মাত্র। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে বই ছড়িয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর এই কিঙ্কর আহসান। বই নিয়ে দেশে সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপনও তার করা। বাহিরের দেশগুলোতে বই, বইয়ের কথাকে যেভাবে প্রচারিত করা হয় বাংলাদেশেও ঠিক তেমনভাবেই যেন বই নিয়ে কথা হয় সেই আশা ব্যক্ত করেন সবসময়।

মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এক লেখক কিঙ্কর আহসানের বই ছড়িয়ে দেয়ার এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক। লেখক বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বেড়ে উঠুক সবার মনে। জায়গা করে নিক বাংলা সাহিত্যের সবার উপরের স্থানে। ভালো থাকুক কিঙ্কর আহসান। পৃথিবী বইয়ের হোক। ‘লেখক’ হোক প্রিয় স্বপ্নের নাম। হাতে ফোন না রেখে বই রাখা বেশি জরুরী, এই কথা সবাই বুঝে উঠুক। শুভ জন্মদিন কিঙ্কর আহসান।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *