শোকাবহ ১৫ আগস্ট ও একটি স্বপ্নের অকাল মৃত্যু : বুঝহ লোক যে জানহ সন্ধান!

আজ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকী।

১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল!

পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্ত, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবনেতা ও সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। ছোট্ট রাসেলের শেষ আকুতি টলাতে পারেনি খুনীদের মন।

. এম ওয়াজেদ মিয়া,‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা বাংলাদেশগ্রন্থে রাসেলকে হত্যার  নৃশংস বর্ণনা দিয়েছেন——-

“আল্লাহ’র দোহাই আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানীতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানীতে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিন” মৃত্যুর আগে খুনীদের কাছে এই আকুতি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলের। তবে সেদিন রাসেলের এই আর্তচিৎকারে খোদার আরশ কেঁপে উঠলেও টলাতে পারেনি খুনী পাষাণদের মন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মত এই নিষ্পাপ শিশুকেও পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান!

সন্দেহ নেই, ১৫ আগস্টের ঘটনা ছিলো চত্রান্তকারীদের সুপরিকল্পিত হত্যা চক্রান্ত। তাতে বিদেশি চক্রান্তকারীরাও যুক্ত ছিলো এবং এই চক্রান্ত্রের আসল লক্ষ্য ছিলো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকার পরিবর্তন নয়; কারণ, সামরিক বাহিনীর সকল অংশ এবং সকল প্রধানের সমর্থন চক্রান্তকারীরা পেতোনা। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল নায়কদের হত্যা এবং স্বাধীনতার মৌলিক চরিত্রকে ধ্বংস করে একাত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়া এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা না গেলেও তাকে পাকিস্তানের ক্লায়েন্ট স্টেটে পরিণত করা!

সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’

বঙ্গবন্ধু নেই! কিন্তু তাঁর আদর্শ আছে, তাঁর স্বপ্ন-প্রত্যাশা আছে, আছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাঁর আদর্শ তাঁর জীবন ও কর্মের মধ্যেই বিধৃত হয়ে আছে। তাঁর স্বপ্নের কথা, প্রত্যাশার কথাও কারো অজানা নেই। কী ধরনের দেশ ও সমাজ তিনি কামনা করতেন, তাঁর আত্মজীবনী পড়লে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশ এবং শান্তি ও সহাবস্থানমূলক সমাজের প্রত্যাশা করতেন। এ প্রত্যাশা পূরণের জন্যই তিনি জীবনব্যাপী রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনিই আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তিনি দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার কাজ শুরু করেছিলেন, যা শেষ করে যেতে পারেননি। ঘাতকচক্র সে সুযোগ তাঁকে দেয়নি। সোনার বাংলা গড়তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নির্মাণে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁর নেতৃত্বে ও মাধ্যমে আমরা স্বাধীন স্বদেশের অধিকারী হয়েছি বটে, তবে এখনো তাঁর স্বপ্নের সোনারবাংলা, শান্তিপূর্ণ ও সহাবস্থানমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।যা এখনো চলমান। সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য-সংহতিও নিশ্চিত করতে পারিনি। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতির মধ্যে নানা রকম বিভক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, যা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য ইতবাচক নয়।

বঙ্গবন্ধু ত্যাগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর অনুসারীদের অনেকেই ত্যাগের বদলে ভোগের রাজনীতির দিকে ছুটে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন বঞ্চিত, নিপীড়িত, অধিকারহারা ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য রাজনীতি করে গেছেন।তিনি গণতন্ত্রের জন্য লাগাতার সংগ্রাম করে গেছেন।বঙ্গবন্ধুর নীতি-আর্দশের এই ব্যতয় ঘটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না ।

আমার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে, একটি মুক্তি সংগ্রামের নায়ক এবং একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রধানকে সপরিবারে নৃশংস হত্যার বিচার বন্ধ রাখার জন্য প্রথমে ঘাতকদের জন্য ইমডেনটিটি অধ্যাদেশ জারি, তার পর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি এই বিচার শুরু হলে তা বন্ধ রাখার চেষ্টা আরো পরে বিচারকদের আপিল শুনানিতে বিব্রত বোধ করা ইত্যাদি এতো কিছুর পরেও দেশের সাধারণ আইনে, সাধারণ বিচার ব্যবস্থায় বিষয়টি যখন হলো এবং একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অপরাধীরা যখন দেশের সকল মহলের কাম্য শাস্তি পেতে যাচ্ছে, তখনো এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে, হত্যাকারীদের সম্পর্কে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী বিভ্রান্তি সৃষ্টির ‘নৈতিক বল’ খুঁজে পান কেমন করে?

আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন,

                                            Some people can be fooled for some time, But all people can not be fooled for all time (কিছু সময়ের জন্য কিছু লোককে হয়তো বোকা বানানো যায়, কিন্তু সব লোককে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায় না)।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার সকল দুরভিসন্ধির সাথে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী ও পাকিস্তানী চক্র এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের গোপন আতাতের কথা আজ দেশের মানুষের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। আজ মানুষ বুঝতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাদেশের নাম চিরতরে মুছে ফেলবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। কিন্তু তাদের সেই বিশ্বাসঘাতকতা, উচ্চবিলাসী ধ্যানধারণা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। সূর্য অস্তমিত হলেই তারপর জোনাকিরা জ্বলে। কিন্তু জোনাকিরা কখনোই সূর্যের বিকল্প হতে পারে না। যতোই দিন যাচ্ছে এ সত্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। ইতিহাসে একাকার দুটি সত্তা। বাঙালি জাতির সকল অর্জন ও সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর মহত্তম অবদান। বঙ্গবন্ধু চিরবহমান বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের মূলস্রোতে।

তিনি অমর, অবিনশ্বর, মৃত্যুঞ্জয়ী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, ভাষা,সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মাঝে চির জাগ্রত।

অন্ধকারে আচ্ছন্ন,আমাদের আলোর আকাশ দেখিয়ে  অজস্র স্বপ্ন দুচোখে গেঁথে ঘুমাচ্ছেন বাবা-মায়ের ‘খোকা’, গ্রামবাসীদের ‘মিয়া ভাই’, বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক:

রায়হান রিয়াজ (তপু),শিক্ষার্থীজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

ডেলিগেটসইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল মডেল ইউনাইটেড ন্যাশনস

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *