এইডস প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি

মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধংসকারী ভাইরাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এইচআইভি। এইচআইভি মানে হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। আর প্রাণঘাতী এক নির্মম মরণব্যাধির নাম এইডস। এর মানে অ্যাকুয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম। যার অর্থ ‘অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতির লক্ষণসমূহ’। অর্থাৎ এইচআইভি ভাইরাসজনিত একটি রোগের নাম হলো এইডস। আর এইডস শুধুমাত্র একটি মাত্র রোগ নয়। এইচআইভি এমন এক ভাইরাস, যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। ফলে যে কোনো সামান্য রোগও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আবার কিছু কিছু রোগ যেমন মুখের ছত্রাক, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া ইত্যাদি ঘন ঘন হতে পারে যা যথাযথ চিকিৎসায়ও নিরাময় করা সম্ভব হয় না। লাল ফিতা এইচআইভি-পজিটিভ মানুষ এবং এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে একাত্মতার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রতীক।

১৯৭০ সালে প্রথম ব্যাপক হারে মানবদেহে ভাইরাসটির অস্তিত্ব শনাক্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বে প্রতিদিন এ রোগে সাড়ে ৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হন। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে এইডস আক্রান্ত মানুষ ৩৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন। তাদের ১৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন নারী এবং ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন শিশু। ২০১৮ সালে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ। এ রোগে মারা গেছে ৭ লাখ ৯০ হাজার জন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এইচআইভি/এইডস রোগী প্রায় ১৩ হাজার। চিকিৎসার আওতায় এসেছে ৬ হাজার ৬০৬ জন।

১৯৮৮ সাল থেকে এইডসের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বে এ দিবসটি পালন করে থাকে। এইচআইভি সংক্রমণের জন্য এইডস মহামারী ছড়িয়ে পড়া বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এবং যারা এই রোগে মারা গেছে তাদের প্রতি শোক পালন করতে এই দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে।অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১লা ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়।

এবারের প্রতিপাদ্য ‘সারা বিশ্বের ঐক্য, এইডস প্রতিরোধে সবাই নিব দায়িত্ব’। এইডস প্রতিরোধে এর লক্ষ্মণ, প্রতিকার ও সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে এইডসের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষণ নেই। দেশ ও স্থানভেদে এইডসের লক্ষণের পার্থক্য দেখা যায়। এইডসের কিছু সাধারণ লক্ষণ যেমন অনেকদিন বা বার বার জ্বর হয় কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, অতিরিক্ত অবসাদ, শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পাওয়া, লিম্ফগ্রন্থি ফুলে ওঠা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাড়ের জয়েন্টগুলো ফুলে থাকা, ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া যেমন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবের প্রদাহ। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ডায়রিয়ার সমস্যা যা স্বাভাবিক চিকিৎসায় কোনোক্রমেই ভালো হয় না, দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা কমে যাওয়া, তীব্র মাথাব্যথা ইত্যাদি। তবে কারও মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা দিলেই তার এইডস হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণ দেখা দিলেই বিলম্ব না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। পাশাপাশি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ কিংবা শরীরের অন্যন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করলে এ রোগের বিস্তার ঘটবে।

অসচেতনতা, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, সুস্থ জীবনের অনুশীলন না করাটাই এ রোগের প্রধান ঝুঁকি। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উপায়ে এইচআইভি ছড়াতে পারে। যেমন: এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত রোগীর রক্ত বা রক্তজাত পদার্থ অন্য কোনো ব্যক্তির দেহে পরিসঞ্চালন করলে, আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক ব্যবহৃত টুথব্রাশ, সুচ, সিরিঞ্জ, ছুরি, ব্লেড বা ডাক্তারি কাঁচি সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত না করে অন্য কোনো ব্যক্তি ব্যবহার করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির অঙ্গ অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে, এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত মায়ের মাধ্যমে (গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে বা সন্তানের মায়ের দুধ পানকালে), অনৈতিক ও অনিরাপদ বা কনডম ছাড়া যৌনমিলন করলে। সমকামী, বহুগামী ব্যক্তি এবং বাণিজ্যিক ও ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে অরক্ষিত যৌনমিলনের মাধ্যমে, যুবসমাজের মধ্যে নেশার আধিক্য এবং একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে বার বার মাদকদ্রব্য গ্রহণ, এইচআইভি আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিবিড় ভৌগোলিক অবস্থান, দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা এবং এভাবেই বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়ায় উপরোক্ত উপায়ে এইচআইভি ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। শ্রমিক অভিবাসন ও মানব পাচারের ফলে এইডস আক্রান্ত জনগণের দেশে গমনাগমন এ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এইডসের ভাইরাস বহনকারী আক্রান্ত পুরুষের মাধ্যমে নিজেদের অজ্ঞতার কারণে নারীও এইচআইভি পজিটিভ হয়ে যায়। সর্বোপরি এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা ও সঠিক তথ্যের অভাবে রোগটি ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।

এইচআইভি এইডসে আক্রান্তদের নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা ও বৈষম্য রয়েছে। তাদের এই কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা ও বৈষম্য দূর করতে হবে। মানুষের ধারণা হয় আক্রান্ত মানুষের জীবনাচার ভালো নয়, ইসলামিক নয়। আর এজন্যই তিনি এইডসে আক্রান্ত হয়েছে। এরকম ধারণা নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি চলছে। আর এটা দূর করার জন্য পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে ইসলামিক প্রোগ্রামগুলোতে এইচআইভি এইডস সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে কারণ জনসচেতনতা তৈরিতে মিডিয়ার অনেক ভূমিকা আছে। এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। আর কারও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে যেকোনো ইনফেকশনেই মৃত্যু হতে পারে। তাই ওষুধ দিয়ে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করা হয়। তবে সুসংবাদ এই যে, এইচআইভি ভাইরাস ছোঁয়াচে নয়। সুতরাং আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে মেলামেশা করলে এ রোগ ছড়ায় না। বরং আমাদের উচিত আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি সমবেদনা জানানো, যত্ন করা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা।

এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করার লক্ষ্যে প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করা উচিত। পারিবারিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ইতিবাচক মনোবৃত্তির পরিচর্যা, উন্নত মননশীলতা একান্তই জরুরি। যুবসমাজ এইডস প্রতিরোধে অসাধারণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা যদি অবাধ ও অনিরাপদ যৌনাচার থেকে বিরত থাকে, তাহলেই এইডস প্রতিরোধ সম্ভব। পড়ালেখার পাশাপাশি তরুণরা পল্লি এলাকার অশিক্ষিত জনগণদের এইডস প্রতিরোধে করণীয় দিক নিয়ে শিক্ষামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। যুবসমাজ এইডসে আক্রান্ত জনগণ ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে এইডস প্রতিরোধসংক্রান্ত উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। ‘সচেতন হও, এইডস থেকে বেঁচে যাও’ মূলমন্ত্র সামনে নিয়ে এ কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। এইডসে আক্রান্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে দেশব্যাপী ছাত্রকল্যাণ তহবিল গঠন করা যেতে পারে।

এইডস প্রতিরোধ করতে দেশব্যাপী যুবসমাজ প্রতিটি জেলায় ‘এইডস প্রতিরোধে যুবসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এইডস থেকে বেঁচে থাকার জন্য যুবসমাজসহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সব পর্যায়ে ব্যাপক জনসচেতনতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা একান্ত প্রয়োজন। এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে মাদক ও এইডসের ভয়াবহতা এবং কুফল সম্পর্কে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর (যৌনকর্মী, হিজড়া, সমকামী, কয়েদি) মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিতে হবে ব্যাপক কর্মসূচি। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ওপর এ হুমকি ও সংকটাবস্থার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কারণ বাংলাদেশ সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রয়াসের মাধ্যমে ইতোমধ্যে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের হুমকি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করেছে। শুধু প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ এবং এর কার্যকর বাস্তবায়ন।
এইচআইভিকে প্রতিরোধ করতে হলে এইচআইভি কীভাবে ছড়ায়, কারা আক্রান্ত হয়, এইচআইভি থেকে নিজেকে কীভাবে মুক্ত রাখা যায় এ বিষয়গুলো সবাইকে জানতে হবে এবং সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। কার্যকর পদক্ষেপ ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই এইচআইভির সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।

তথ্যসূত্র: গুগল ও উইকিপিডিয়া

 

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *