তবে কী চীন এক নয়া সাম্রাজ্যবাদী দেশ হয়ে উঠছে? চীনের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতি ও কর্মকাণ্ডে নয়া সাম্রাজ্যবাদের নমুনা স্পষ্ট। বিভিন্ন ঋণের ফাঁদে ফেলে দুর্বল দেশগুলোতে একপ্রকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে চীন। বর্তমানে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে ঋণের ফাঁদে ফেলে অভ্যন্তরীন রাজনীতি ও অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে চীন। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের কর্তৃত্ব নিয়েছে চীন ৯৯ বছরের জন্য। এছাড়া আফ্রিকার দেশ কেনিয়া ঋণের ফাঁদে পরে শর্ত অনুযায়ী তাদের প্রধান সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশও একই পরিস্থিতিতে আছে। চীনা ঋণের ফাঁদে পরেছে- আলবেনিয়া, বসনিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কসোভো, মেসিডোনিয়া ও মন্টিনিগ্রো। আইএমএফ বলছে, ২০১৫ ও ২০১৭ সালের মধ্যে চীনের এক্সপোর্ট ও ইমপোর্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে এসব দেশ। বলকান এই রাষ্ট্রগুলোর জিডিপির প্রায় এক চতুর্থাংশ-ই ব্যয় হচ্ছে এ ঋণ পরিশোধে। অনেক দেশ এ ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে চীনের হাতে তুলে দিচ্ছে তাদের ভূমি, সমুদ্রবন্দর ও বিমান বন্দর।ব্যবসায় সুবিধা করার জন্য চীন এসব দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের পছন্দমতো সরকার গঠন করে দিতে চায়।
নয়া সাম্রাজ্যবাদ ধারনাটির উদ্ভব হয়েছে কলোনিয়ালিজম থেকে। ক্যাপিটাল ইকোনমির প্রভাবে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়ে কলোনিয়ালিজম থেকে সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান নয়া সাম্রাজ্যবাদ বা নিও ইম্পেরিয়ালিজম। বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির এই আধুনিক ব্যবস্থার প্রচলন এবং বিভিন্ন দেশ তা কীভাবে কাজে লাগিয়েছে তা বুঝতে হলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে কলোনিয়ালিজম সম্পর্কে।
একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব সার্বভৌম এলাকা ছাড়া যখন অন্য একটি দুর্বল দেশ বা অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তখন তাকেই উপনিবেশবাদ বা কলোনিয়ালিজম বলে। এই প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী রাষ্ট্রকে কলোনাইজিং পাওয়ার এবং যে দুর্বল রাষ্ট্র তাকে কলোনাইজড দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কলোনাইজিং দেশগুলো মূলত কলোনাইজড দেশের সম্পদ, লেবার বা জনশক্তি শোষন করে পাশাপাশি কলোনাইজড দেশের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে।
আধুনিক উপনিবেশবাদ শুরু হয় ১৫০০ সালের শুরুর দিক থেকে। ১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিষ্কার এবং সমুদ্রপথ আবিষ্কারের পর থেকেই আধুনিক উপনিবেশবাদের সূচনা। প্রথমদিকে স্পেন, পর্তুগাল কলোনাইজিং পাওয়ার থাকলেও কিছু পরে তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস(ডাচ) সহ অন্য কিছু দেশও কলোনাইজিং পাওয়ার হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। উপনিবেশবাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি যে দেশ পরিচিত তা হল- ব্রিটেন। বিশ্বের সকল কলোনাইজড দেশগুলোর প্রায় ৭০ ভাগই ছিলো ব্রিটেনের অধীনে।
শক্তিশালী দেশগুলো দুর্বল দেশগুলোতে কলোনি স্থাপন করে বিভিন্নভাবে শোষন চালিয়ে তাদের স্বার্থসিদ্ধ করতো পাশাপাশি তারা কলোনাইজড দেশগুলোতে অল্পবিস্তর উন্নতিও সাধন করতো কিন্তু এর পেছনের শক্তিশালী দেশের আলাদা কিছু উদ্দেশ্য কাজ করতো। প্রথমত যোগাযোগের জন্য রেলপথ অথবা সমুদ্রবন্দর তৈরি করলেও মূল উদ্দেশ্য ছিলো তাদের নিজস্ব মালামাল সহজে স্থানান্তরিত করা। আবার কখনও কলোনাইজড দেশে কলোনাইজিং দেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন হতো। এই আন্দোলন যাতে না হয় এজন্য কিছু উন্নতি করতো যাতে তাদের প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে হয়। অল্পবিস্তর কিছু উন্নতি হলেও প্রধানত যে শোষনই চলতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শক্তিশালী দেশগুলোর কলোনি স্থাপনের মূল কারণ ছিলো পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তখনকার সময়ে বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান দেশেই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলন ছিলো। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত নতুন বাজারের প্রয়োজন হয়। ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির জন্য দেখা যেত একটি দেশে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের উৎপাদন অনেক বেড়ে যেত ফলে সেই বাজারে তা অবিক্রীত থেকে যেতো। আর একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র অপর একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সুবিধা করতো পারতো একই রকম পণ্যের আধিক্যের কারণে। তাই পুঁজিবাদী বা ক্যাপিটালিস্ট দেশগুলো অপুঁজিবাদী দেশগুলো সন্ধান করতো নতুন বাজার তৈরির জন্য। প্রাথমিকভাবে এটিই ছিলো কলোনিয়ালিজম প্রতিষ্ঠার মূল কারণ।
শক্তিশালী বা কলোনিয়াল দেশগুলো প্রাথমিকভাবে ব্যবসার উদ্দেশ্যে গেলেও পরে তারা বুঝতে পেরেছিল যে এই কলোনাইজড অঞ্চল বা দেশ থেকে আরও লাভবান হওয়া সম্ভব। কলোনাইজিং দেশগুলো অতি সস্তা দামে বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ করতো কলোনি থেকে। ধীরে ধীরে কলোনি কাঁচামালের এক সহজলভ্য কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। অতি কম দামে কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্য কলোনি থেকে সংগ্রহ করে কলোনাইজিং দেশগুলো সেটি ইউরোপিয় বাজারে চড়া দামে বিক্রয় করতো। এই বাণিজ্যের ধারা অব্যাহত রাখার জন্যে কলোনাইজিং দেশগুলো কলোনাইজড দেশের ক্ষমতাধর সম্প্রদায় অথবা রাজাদের বিভিন্ন উপঢৌকন ও আর্থিক সহায়তার পাঠানোর মাধ্যমে তাদের হাতিয়ে নিত। ফলে অবাধে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারতো। এভাবেই বিভিন্নভাবে শোষনের দ্বারা কলোনি থেকে লাভবান হবার জন্য কলোনাইজিং দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো এবং ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান হলো।
অধিক লাভের আশায় কলোনাইজিং দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। প্রত্যেক ক্ষমতাধর ইউরোপিয় দেশ চাইতো তাদের নিজস্ব কলোনি থাকুক। ফলস্বরূপ এক কলোনিয়াল পাওয়ার দেশের সাথে অন্য দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকতো। কলোনি যেন হারাতে না হয় এজন্য কলোনিয়াল দেশগুলো তাদের কলোনিতে সশস্ত্র বাহিনী ও গোলাবারুদ মজুদ করে রাখতো এসব যুদ্ধ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য। আবার যখন কোনো দেশ তার কলোনি হারিয়ে ফেলতো যুদ্ধে হারার কারণে তারা তাদের কলোনি পুনরায় ফিরে পাবার জন্যে যুদ্ধ করতো। এসব যুদ্ধে প্রচুর প্রানহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হতো। এছাড়া এসব যুদ্ধের জন্য কোন কোন দেশ বিশ্বজুড়ে নিন্দার শিকার হতো, চাপের মুখে পড়তো। প্রত্যক্ষ যুদ্ধ এবং ধ্বংসলীলা দুই দেশ এমনকি কলোনাইজিং দেশেরও ক্ষতিসাধন করতো। তাই পরবর্তীতে নয়া সাম্রাজ্যবাদ ধারণাটির উদ্ভব হলো।
নিও ইম্পেরিয়ালিজম বা নয়া সাম্রাজ্যবাদ ব্যবস্থায় যুদ্ধ এড়িয়ে কার্যসিদ্ধি করা যায় তাই এটি অধিক নিরাপদ সাথে সাথে লাভবানও হওয়া যায়, অন্য দেশের উপর প্রভাব বিস্তার করা যায়। বর্তমান বিশ্বে নয়া সাম্রাজবাদ অধিক সমাদৃত। শক্তিশালী বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের সহায়তা ও ঋণের ফাঁদে ফেলে দুর্বল দেশকে শোষণ করে এবং তাদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকে। এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শক্তিশালী দেশটি দুর্বল দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে স্বার্থসিদ্ধ করে থাকে।
আধুনিক বিশ্বে এটি প্রথম মার্কিনীরা শুরু করে এবং তারা এই ধারা এখনও অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া অন্যান্য শক্তিধর দেশ যেমন- রাশিয়া, চীন সহ আরও কয়েকটি দেশ এই নয়া সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে চীন নয়া সাম্রাজ্যবাদের একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। চীন বিভিন্ন দেশে সাহায্য ও সহযোগিতার নাম করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। আফ্রিকা, ইউরোপ সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীনের এই নয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব স্পষ্ট। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, চীনের বিআরআই (BRI) প্রকল্প এই নয়া সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠারই অংশ। বিআরআই (BRI) প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ৭০ টি দেশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে এবং সহজেই পণ্যের আদান প্রদান করা যাবে। এতে এই প্রকল্পে থাকা দেশগুলো লাভবান হবে বটে কিন্তু অনেক দেশের অবকাঠামো এই প্রকল্পের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে চীন এসব দেশের অবকাঠামো যেমন- সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর সহ বিভিন্ন কাজে প্রচুর ঋণ সহায়তা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছে এটি আসলে চীনের তৈরি একটা ঋণের ফাঁদ যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে চীন তাদের অধীনে আনতে চাইছে।
চীন বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিনদের এক শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতেও একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম হয়ে উঠেছে। এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্যই এই ঋণ সহয়তার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে তাদের অধীনস্থ করে রাখার প্রচেস্টা করছে চীন যেটায় অনেকাংশেই সফল তারা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাপিয়ে আধিপত্য বিস্তারে এগিয়ে যাবে চীনারা।
লেখক: মোঃ তৌহিদুল ইসলাম রাসো। ২য় বর্ষ; ৪র্থ সেমিস্টার, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,বিউপি
তথ্যসূত্র:
১. https://www.britannica.com/topic/Western-colonialism
২. যুগান্তর (24th May 2018)
৩. বিবিসি বাংলা (29th July 2017)
৪. প্রথম আলো (6th February 2019)