জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশন বসছে আজ; বিভিন্ন পর্যায় থেকে প্রতিক্রিয়া

জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশন বসছে আজ। অন্যান্যবারের চেয়ে ভিন্ন ধরনের এক পরিস্থিতিতে বর্তমান জাতীয় সংসদের অষ্টম এ অধিবেশন শুরু হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংসদ সচিবালয় থেকে এবার একেবারেই অন্যভাবে বাজেট অধিবেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আজ বুধবার বিকাল ৫টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হবে।

করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় বাজেট উত্থাপনের দিন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানোর রীতি থাকলেও এবার তা করা হয়নি। এবারের বাজেট অধিবেশনে গণমাধ্যমকর্মীদের সংসদে না গিয়ে সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে বাজেট অধিবেশনের সংবাদ সংগ্রহ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বাজেট অধিবেশনে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সংসদ সচিবালয়। এক্ষেত্রে শারীরিকভাবে অসুস্থ ও বয়স্ক সংসদ সদস্যদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। রোস্টারভিত্তিক সংসদ সদস্যদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংসদের অত্যাবশ্যকীয় প্রায় ৪০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৩ জন সংক্রমিত বলে শনাক্ত হয়েছেন। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে। আর অন্যদের সংসদ অধিবেশন চলাকালে নিজেদের বাসায় কিংবা সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা গড়ে তিনদিন করে অধিবেশনে যোগ দেয়ার সুযোগ পাবেন। এর মধ্যে একদিন তারা বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেবেন। কোনো কোনো সংসদ সদস্য তিনদিন অধিবেশনে যোগ দেয়ার সুযোগ পেলেও বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রিসভার অত্যাবশ্যকীয় কয়েকজন সদস্য, সরকারি ও বিরোধী দলের হুইপরা এই শিডিউলের আওতায় পড়বেন না। এদিকে বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০-২২ জন সংসদ সদস্যকে বাজেট অধিবেশনে অংশগ্রহণ না করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন নারী সংসদ সদস্যও রয়েছেন।

জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে বাজেট অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা রোস্টারভিত্তিক যোগ দেবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। এর ভিত্তিতে সংসদের চিফ হুইপ, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও অন্যান্য হুইপ বসে এরই মধ্যে রোস্টার তৈরি করেছেন। রোস্টার অনুযায়ী বেশির ভাগ সংসদ সদস্য তিনদিন করে অধিবেশনে যোগ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। একজন সদস্য পাচ্ছেন দুদিন অধিবেশনে যোগ দেয়ার সুযোগ। আবার মন্ত্রীসহ আবশ্যকীয় কিছু এমপি তিনদিনের বেশি বৈঠকে আসার সুযোগ পাচ্ছেন। এক্ষেত্রে কারো কারো জন্য অধিবেশনের সবগুলো কার্যদিবসে অংশগ্রহণের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। বাজেট পাসের দিন ৩০ জুন প্রয়োজনীয়তার তাগিদে যতদূর সম্ভব মন্ত্রীদের বেশি উপস্থিতি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, অধিবেশন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কেবল কোরাম পূর্ণ হওয়ার (৬০ জন) ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের উপস্থিতি সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৯০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে সংসদ থেকে এ অধিবেশনের একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অধিবেশনের মেয়াদ হবে ১২ কার্যদিবস। আগামী ৮ বা ৯ জুলাই অধিবেশন শেষ হবে। অধিবেশনে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ হবে ১১ জুন। আর বাজেট পাস হবে ৩০ জুন। সম্পূরক ও মূল বাজেট নিয়ে ২০-২২ ঘণ্টা আলোচনা হবে বলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংসদের অধিবেশন শুরুর পরদিন ১১ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বেলা ৩টায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করবেন। বাজেট পেশের পর ১২ ও ১৩ জুন সাপ্তাহিক ছুটিতে অধিবেশনের মুলতবি থাকবে। ১৪ ও ১৫ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনা ও সম্পূরক বাজেট পাস করা হতে পারে। এর পরদিন ১৬ জুন প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের সাধারণ বাজেটের ওপর আলোচনা শুরু হবে। ২৯ জুন সোমবার বাজেটের ওপর সমাপনী আলোচনা হবে। এদিনই পাস হবে অর্থ বিল। ৩০ জুন মূল বাজেট ও নির্দিষ্টকরণ বিল পাস করা হবে। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, অধিবেশন শুরু ও বাজেট পেশের দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদের বৈঠক শুরু করে একটানা বেলা দেড়টা পর্যন্ত চালানোর কথা রয়েছে।

বিএনপি’র বাজেট-ভাবনা

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর না দিয়ে মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মঙ্গলবার (৯ জুন) দুপুরে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র বাজেট ভাবনা: অর্থবছর ২০২০-২১’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, এ সংকটকালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে জোর না দিয়ে মানুষের জীবন রক্ষা ও জীবিকার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। মন্দাকালীন বিনিয়োগ, ভোগ ব্যয় ও রফতানি কমে যাওয়ায় সামষ্টিক চাহিদা বাড়াতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিতে সর্বাধিক জোর দিতে হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সার্বজনীন মৌলিক প্রয়োজনীয় যেমন-স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রমকল্যাণ, কৃষি, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতের বহুমুখীকরণ, উৎপাদন ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো কৌশলগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

টিআইবি’র প্রস্তাব

এ প্রসঙ্গে টিআইবি’ র নিার্বাহী পরিচালক বলেছেন, এবছর স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় কম রাজস্ব আয় হবে এটা ভেবেই জনগণের জন্য বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

ব্যাংক ঋণ, বৈদেশিক ঋণের প্রতি না: অর্থনীতি সমিতি

ওদিকে সোমবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬শো কোটি টাকার একটি বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। তিনি এ বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা হাজির করে সতর্ক করে দেন, দারিদ্র্যবিমোচন নিয়ে অতীতে যেসব কথাবর্তা হয়েছে, সেসব ভুলে যান। বাংলাদেশে ২৬ মার্চের আগের অবস্থা নেই। লকডাউনের ৬৬ দিনে ঘটনা ঘটেছে মারাত্মক। সামনে আরও অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করতে হবে। তাই বাজেট হতে হবে বাস্তব উপযোগি এবং ব্যাংক ঋণ বা বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করা যাবে না।

এদিকে, দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) রোববার (৭ জুন) এক ভার্চুয়াল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে দেশের বেশিরভাগ খাত ধুকতে থাকায় চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আড়াই শতাংশের বেশি হবে না। এটা মাথায় রেখেই বাজেট পরিকল্পনা করতে হবে।

এফবিসিসিআই’র প্রস্তাবনা

এর আগে, সোমবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক অনলাইন সেমিনারে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা অভিমত দিয়েছেন করোনার প্রভাবে দেশের স্থবির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা জরুরি। এক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে জোর দিতে হবে।

কী বলবেন অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় মানুষের জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবেন। পাশাপাশি মহামারি কাটিয়ে ওঠার জন্য পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের স্মার্ট বাজেটের বক্তব্য শেষ করবেন।

সুরা আল-বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতের অর্থ হচ্ছে ‘অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে এবং রোগীকে সুসংবাদ দাও।’

উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতবছর বাজেট আধিবেশনের সময় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। অসুস্থতা নিয়েও জীবনের প্রথম বাজেটটি উত্থাপন করতে গিয়ে বক্তৃতার একপর্যায়ে তাকে বসে পড়তে হয়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রীকেই আর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা পাঠ সমাপ্ত করতে হয়েছিল।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *